ব্রিটিশ বাংলাদেশি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে লন্ডনে সুবিশাল ও বিভিন্ন শহরে বিলাবহুল শাখা অফিস খুলেছিলে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের দুই ভাই আব্দুল অদুদ দীপক ও আহমেদ হুমায়ুন হাবীব। বিনিয়োগকারীদের টাকায় সিলেট ও ঢাকা শহর এবং মৌলভীবাজারের শেরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েক কোটি টাকার জমি ও সম্পদ কিনেছেন এই দুই ভাই। এছাড়া লন্ডনে কিনেছেন নামে-বেনামে অন্তত ৬টি ঘর। আমানত সংগ্রহের পর গত দশ মাস ধরে অসংখ্যবার তারিখ দিলেও মানুষের আমানত ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো লন্ডন ছেড়ে দুবাই পাড়ি দিয়েছেন তারা। খবর ‘বাংলাট্রিবিউন’র।
জানা গেছে, দীপক ও হাবীবের লন্ডনের বাঙালিপাড়ার ৮৫ মারডল স্ট্রিটের অফিসটি বর্তমানে তালাবদ্ধ। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে তারা পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের অর্থ ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনও বিনিয়োগকারী অর্থ ফেরত পাননি। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব লন্ডনে ৮৫ মারডল স্ট্রিট ঠিকানা দিয়ে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউজে হাবিবসন্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির নিবন্ধন রয়েছে। কোম্পানিটির নিবন্ধিন নম্বর ১১০৭০৫৮২ যা নিবন্ধন করা হয়েছিল আব্দুল অদুদ দীপক ও আহমেদ হুমায়ুন হাবীবের নামে। গত চার বছরে তার আরো বেশ কয়েকটি কোম্পানি নিবন্ধিত করে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি তারা নিজেরাই বন্ধ করে দেয়। হাবিবসন্স নামের কোম্পানিটির নিবন্ধন ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর বাতিল হয়।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, কোম্পানিটি বন্ধ হলেও এই কোম্পানির সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে থাকেন দীপক ও হুমায়ুন। এর পাশাপাশি তারা দুবাইভিত্তিক প্যাসিফিক গ্লোবাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামের আরেকটি কোম্পানির পক্ষ থেকে গ্রাহকদের চুক্তিপত্র দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। মূলত ফোরেক্সের মতো শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও কারেন্সি মার্কেটে বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নেওয়া হত। গ্রাহকদের বলা হয়, আমানতের ৯৫ শতাংশ অর্থের বিপরীতে বিমা করা থাকবে, তাই বিনিয়োগ হালাল ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ব্যবসায় ক্ষতির কথা বলে গ্রাহকদের লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
টাকা ফেরতের বহু তারিখ ও পরিকল্পনার কথা জানালেও দুই ভাই কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। হুমায়ুন প্রতিদিন দশ-বারো জন করে গ্রাহকদের নিয়ে অনলাইনে জুম মিটিং করে এখনও টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানাযায়, প্রয় চারশ জন এই কোম্পানিতে মোট বিনিয়োগ করেছে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। যাদের মধ্যে ব্রিটেনে মোট গ্রাহক তিনশ’ জনের আর দেশে আছেন আরও শতাধিক।
গ্রাহকরা টাকা ফেরত পেতে কমিউনিটিতে কমিটি গঠন, বৈঠকের পর বৈঠকসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। টাকা ফেরত পেতে কমিটিও করা হয়। কমিটির সদস্যরা দুবাইতে গিয়ে হুমায়ুনের সঙ্গে বৈঠক করলে তিনি কিছু হিসাব দেখিয়ে টাকা পর্যায়ক্রমে ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেন নভেম্বর মাসে। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি গোপনে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিনিয়োগের কিছু অর্থ ফেরত দিয়েছেন দুই ভাই। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির পদবিধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী। ইতোমধ্যে একজন ভুক্তভোগী বাদী হয়ে দীপক ও হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।
সিলেটের হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের বাসীন্দা হুমায়ুন ও তার মা একযুগ আগে বাবা ছালিক মিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সূত্রে ব্রিটেন আসেন। দীপক ব্রিটেন আসেন স্টুডেন্ট ভিসায়। বর্তমানে হুমায়ুন ও দীপক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুবাইতে অবস্থান করছেন।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আহমেদ হুমায়ুন হাবীব ফোনে বলেন, বিনিয়োগের পরিমাণ দেড়শ’ কোটি টাকা নয়, অনেক কম। ইউক্রেন যুদ্ধ, শেয়ার বাজারের ধারাবাহিক পতনসহ বিভিন্ন কারণে ব্যবসা লোকসানে রয়েছে। তারপরও শিগগিরই টাকা পর্যায়ক্রমে ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রাহকরা আরেকটু সময় দিলে সবার টাকা তিনি ফিরিয়ে দেবেন।
তার বড় ভাই আব্দুল অদুদ দীপক ফোনে বলেন, তিনি নিজে যে ৪১ জন গ্রাহকের কাছ থেকে নিজের নামে চুক্তিপত্র করে টাকা নিয়েছেন সেই টাকা ছাড়া বাকি গ্রাহকদের দায়-দায়িত্ব কোনোভাবেই নেবেন না। তবে একের পর এক তারিখ দিয়েও গ্রাহকদের টাকা ফেরত না দেওয়া, কোম্পানি খুলে গোপনে বন্ধ করা এবং নানা টালবাহানার বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেননি দীপক।
শেয়ার করুন