দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু

রাজনীতি

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুরর মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পরও তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু তার বেশ কিছু ভাষণে চোরাচালান, ঘুষ, কালোবাজারি ও মজুতদারিসহ দুর্নীতি ও অনিয়মের তীব্র নিন্দা করেন। তার অনেক সতর্কবার্তা এবং পরামর্শ এখন সময়ের বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক।

পোস্টকার্ডে দুর্নীতিবাজদের নাম

১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক জোট সরকারে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিবিরোধী এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়েই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেন।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাবে পিরোজপুর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন: “কোনো অফিসে বা আদালতে দুর্নীতি হলে এবং কেউ যদি আপনার কাছ থেকে ঘুষ চায়, অবিলম্বে আমাকে জানান। তিন পয়সার একটা পোস্টকার্ডে দুর্নীতিবাজদের নাম আমাকে লিখে আমাকে জানান। আমি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব যাতে দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ হয়।”

ঘুষখোরকে মাফ করা হবে না বলেও উল্লেখ করে না।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আবারও দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “আজ থেকে আমার একটি অনুরোধ, আজ থেকে একটি আদেশ, নেতা হিসেবে নয়, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়; ভাই হিসেবে। আমি তোমার ভাই, তুমি আমার ভাই।”

তিনি বলেন, “আমার এই স্বাধীনতা বৃথা হবে যদি আমার বাংলার সব মানুষ ভাত না পায়।বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পেলে আমার এই স্বাধীনতা বৃথা হবে। আমার এই স্বাধীনতা বৃথা হবে যদি এদেশের মা-বোনেরা তাদের শালীনতা রক্ষার পোশাক না পায়। আমার এই স্বাধীনতা বৃথা হবে যদি এদেশের মানুষ, তরুণ-তরুণীরা চাকরি না পায়।”

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আমার ভাইয়েরা, আপনারা জানেন, আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। আমি চাই, যেখানে রাস্তা ভাঙা আছে সেখানে জনগনেই সেটা মেরামতের কাজ শুরু করুক। আমি চাই আপনারা সবাই মাঠে ফিরে যান এবং চাষ করুন।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি সরকারি কর্মচারীদের বলতে চাই, ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, আমি ঘুষখোরকে ক্ষমা করব না।”

বাংলাদেশের মাটিতে দুর্নীতির কোনো স্থান নেই

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে কুচকাওয়াজে অংশ তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু আবারও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ঘোষণা করেন এবং জয়ের প্রতিশ্রুতি দেন।

তিনি বলেন, “আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমাদের অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, কিন্তু চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি, চোর, দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে আমি অনুরোধ করেছি, অনুনয়-বিনয় করেছি এবং হুমকি দিয়েছি, কিন্তু চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না।”

তিনি আরও বলেন, “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, যদি আমি পাকিস্তানি অত্যাচারী জিন্নাহ, গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে পঁচিশ বছর ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি এবং যদি আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তবে আমি কি পারব না দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে? অবশ্যই পারবো, ইনশাআল্লাহ। এই বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে চোরাকারবারি, চাঁদাবাজ, মুনাফাখোরদের। আমি এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এবং আপনারাও বাংলার মানুষ হিসেবে এই প্রতিশ্রুতি দিন।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “শহীদেরা এজন্য তাদের রক্ত দেননি। হাজার হাজার চোরাকারবারী, মুনাফাখোর ও ঘুষখোর জাতীয় সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করছে এবং মানুষকে খাদ্য থেকে বঞ্চিত করছে। বাংলার বুক থেকে তাদের উপড়ে ফেলতে হবে। দেখা যাক তারা কতদূর টিকে থাকতে পারে। চোরের শক্তি নাকি মুমিনের শক্তি বেশি তা প্রমাণিত হবে।”

দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিপ্লব

১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার চতুর্থ বার্ষিকীতে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু তার শেষ জনসভায় ভাষণ দেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই ঐতিহাসিক ভাষণের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় যে বঙ্গবন্ধু “দ্বিতীয় বিপ্লব” ব্যাখ্যা করবেন।

 বঙ্গবন্ধু সেদিন তার বক্তৃতায় তিনি ইঙ্গিত দেন যে, দুর্নীতি নির্মূলে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

তিনি চবলেন, “কে আজ দুর্নীতিবাজ? যে প্রতারণা করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্যক্তি পাচার করে সে দুর্নীতিবাজ। যে কালোবাজারি করে সে দুর্নীতিবাজ। মজুতদার দুর্নীতিবাজ। যারা তাদের দায়িত্ব পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশীদের কাছে দেশ বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন প্রয়োজন।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “১৯৭১ সালে আমি আপনাদের প্রতিটি ঘরকে দুর্গে রূপান্তর করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বাংলাদেশের মাটি থেকে দুর্নীতি নির্মূল করাই আজ এক নম্বর অগ্রাধিকার। আমার আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন। আমি আইনের প্রয়োগ করব এবং কাউকে ছাড় দেব না। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে গণআন্দোলন করতে হবে “

জাতির জনক বলেন, “কে এটা করতে পারে? আমার ছাত্র ভাইয়েরা পারবে, তরুণরাই পারে, বুদ্ধিজীবীরা পারেন, জনগণ পারে। প্রতিটি ঘরকে দুর্গে রূপান্তর করতে হবে, তবে এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে, যাতে আমরা বাংলাদেশের মেহনতি জনগণের দুর্ভোগ লাঘব করতে পারি।”

বক্তৃতার তিনি বলেন: “যখন একটি জাতি ভিক্ষা করে, খাদ্য বা অর্থের জন্য ভিক্ষা করে, তখন সেই জাতির মর্যাদা থাকতে পারে না। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে চাই না।আমার এক নম্বর অগ্রাধিকার দুর্নীতি দূর করা। দুই নম্বর কারখানা ও খামারে উৎপাদন বাড়ানো। তিন নম্বর জনসংখ্যা পরিকল্পনা, আর চার নম্বর জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়তে দল গঠন করা হয়েছে। যারা বাংলাকে ভালোবাসেন, এর আদর্শে বিশ্বাসী, রাষ্ট্রের আদর্শকে সম্মান করেন এবং সঠিক পথে হাঁটেন, তারা সবাই এই দলের সদস্য হবেন। বহিরাগত শত্রুর কাছ থেকে টাকা নেওয়া বিদেশী এজেন্টদের কোনো স্থান নেই।”

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *