নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো, যা নিম্নআয়ের ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে খরচ। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, সবই খাদ্যপণ্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য খরচ করার মতো টাকা তাদের হাতে থাকছে না। খরচের চাপ সামাল দিতে তারা কম খাচ্ছেন। নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষ রুই-কাতল মাছ কেনা ভুলে গেছে। তারা কম দামের চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়া-কৈ মাছ খেতেন। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পাঙাশ-তেলাপিয়া কিনতেও ক্রেতাদের হিসাব করতে হচ্ছে।
নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকই দায় হয়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, অস্বাভাবিক ডলারের দাম, দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ চাপ বাড়িয়েছে। আমদানি, উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ বাড়ায় দফায় দফায় দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজারে জেঁকে বসেছেন সিন্ডিকেটকারীরা। সরকার কোনোভাবেই পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, মসলা, সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণীপেশা ও নিম্নআয়ের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। সংসার চালাতে পারছেন না। খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের সব টাকা চলে যাচ্ছে। অন্য মৌলিক চাহিদা যেমন- বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ কমাচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ।
শনিবার নগরীর বিভিন্ন মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি কই মাছ (চাষের) বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা, শিং মাছ (চাষের) ৩৫০-৪০০ টাকা, পাবদা (চাষের) ৩৫০-৪০০ টাকা, কাতল ৪০০ টাকা, রুই ৩০০-৩৫০ টাকা, পাঙাশ (চাষের) ২০০-২২০ টাকা, কেচকি মাছ ৩০০-৩৫০ টাকা, চিংড়ি আকার অনুযায়ী ৬০০-৮০০ টাকা, টেংরা ৫৫০-৬০০ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ ২০০-২২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে শোল মাছ প্রতি কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা, ছোট বোয়াল ৫০০-৫৫০ টাকা, বাইম মাছ ৬৫০-৭৫০ টাকা ও রূপচাঁদা প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর বাগবাড়ী এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন প্রাইভেট চাকুরজীবী রফিক আহমদ। তিনি বলেন, গরু-খাসির গোশত অনেক আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন ডিম-দুধও খাওয়া যাচ্ছে না। গত মাসে ছেলের একটা টিউশনি কমিয়ে দিয়েছি। গত ঈদে কারও কোনো পোশাক কেনা হয়নি। এভাবে আরো কয়েকমাস চললে যে বাসায় থাকছি, সেটাও ছাড়তে হবে। কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে হবে। চাষের কই, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ কিনতাম; এখন সেটাও আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, ছেলেটা বাড়তি আয়ের জন্য টিউশনি শুরু করেছে। তারপরও সংসার চলছে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ায় প্রতি মাসে খরচ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করবো কীভাবে?
রফিক উদ্দিনের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপের তথ্য। সম্প্রতি এক জরিপে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তারা বাধ্য হয়েই কম খাচ্ছেন। গত ৬ মাসে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার গোশত খাওয়া কমিয়েছেন। ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে।
সানেমের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নআয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামের খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে থাকছেন- এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ।
দেশের ৮ বিভাগের নিম্নআয়ের ১৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ করেছিল সানেম। জরিপ প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, মাছ-গোশত ছাড়াও অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা ও ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত কম খাচ্ছে।
সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমরা দেখেছি, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এসব সমস্য দীর্ঘমেয়াদি। শুধু ওই পরিবারের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য করের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধরন। দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে বিকল্প উৎস প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। আরও বিস্তৃত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
গত ১৮ মে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয় গত বছর রাজধানী ঢাকা শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন। তবে ঢাকায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ৪.৩ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে ৩.২ শতাংশ।
বিআইডিএস ২ হাজার ৪৬টি খানার ওপর জরিপ করে এই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, করোনা মহামারির সময় ঢাকায় দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। পরে তা ধীরে ধীরে কমে আসে। করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩.৬০ শতাংশ। করোনার পর গত বছর (২০২২) তা বেড়ে ৩৮.৫৬ শতাংশ হয়েছে। অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫.৪৭ শতাংশ। করোনার পর তা বেড়ে ৩৩.২১ শতাংশ হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ এমএফএস (মোবাইলে আর্থিক সেবা) ব্যবহার করত। করোনার পর, অর্থাৎ ২০২২ সালে তা বেড়ে ৭৮.৭৮ শতাংশ হয়েছে।
বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন জানান, মোট দরিদ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন দরিদ্র, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নেমে গেছে।
সুবিদবাজার এলাকায় বাজার করতে আসা একাধিক ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাছের বাজার এখন উচ্চবিত্ত মানুষের বাজার। মাছের দাম দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে আর কিছু দিন পর নিম্ন আয়ের মানুষ মাছের বাজারে যেতে সাহস করবে না। মাছ কেনা সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এক সময় পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছ ছিল গরিবের মাছ, কিন্তু এখন এই দুই মাছের কেজি পৌঁছেছে ২০০ টাকায়। এই মাছ কিনতেও এখন হিসাব করতে হচ্ছে।
বাজার করতে আসা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। তাই আমরা মাছ বাজারে পাঙাশ ও তেলাপিয়ার মতো মাছ সাধারণত কিনে থাকি। কিন্তু বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী সেই সব মাছ কেনার সক্ষমতা হারাচ্ছি। এভাবে মাছের দাম বাড়তে থাকলে গরু ও খাসির গোশতের মতো মাছ খাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের।
শেয়ার করুন