বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। সোমবার বেলা চারটার দিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার উজ জামান প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের তথ্য জানান। এরপর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের আগে থেকেই সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি গা-ঢাকা দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে অনেকে সুযোগ বুঝে দেশ ছাড়তে পারলেও আটকা পড়েন অনেক মন্ত্রী-এমপিরা। তারা দেশে থাকলেও কোথায় আছেন খোঁজ পাচ্ছেন না কেউ। বন্ধ রয়েছে তাদের মোবাইল ফোনও।
মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হঠাৎ পদত্যাগ ও নিরাপত্তার শঙ্কায় ভারত যাওয়ার পর থেকেই বেকায়দায় পড়েন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এসব মন্ত্রী-এমপিরা। তবে এর আগে যারা পরিস্থতি আঁচ করতে পেরেছিলেন তারা শনিবার থেকেই বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। এসময় অনেক মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও খোঁজ মেলেনি কারো।
সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতার রোষে পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে তাদের না পেয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অনেকে বাড়ি ঘর। বাদ যায়নি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অফিসও। এর মধ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবন, ধানমন্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ক্ষুদ্ধ জনতা।
এমতাবস্থায় শনিবার বিকেল থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিন আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে শেষবারের মতো সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রোববার রাতে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। আরেকটি সূত্র জানায় বর্তমানে নয়াদিল্লিতে আছেন দলটির প্রভাবশালী এই নেতা।
আলোচিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে সোমবার সকালের পরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের। এদিন সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসভবন ভাঙচুর হলেও তিনি ঠিক কোথায় ছিলেন জানা যায়নি।
এর আগে, রোববার আওয়ামী লীগ সরকারের বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বিমানযোগে দেশ ছাড়েন। তবে তারা কে কোন দেশে গেছেন তা জানা যায়নি।
একইদিন রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তার পরিবারের সদস্যদের ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর পাঠিয়ে দেন। মূলত এরপর থেকেই গণহারে মন্ত্রী-এমপিদের দেশ ত্যাগের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর মধ্যে অনেকেই পরিবার পাঠিয়ে দিলেও নিজেরা যেতে পারেননি। এদের মধ্যে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
রোববার বিশেষ প্রটোকল চেয়ে দেয়া চিঠির হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এভসেক-এর সহকারী পরিচালক নাছিমা শাহীনের সই করা তালিকা অনুযায়ী দেশ ছাড়া এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে পূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির (বিজি ৩৯৮), সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী (বিজি ৫৮৪), স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম (বিজি ৩৮৮), সাবেক হুইপ নুর-ই আলম চৌধুরী (বিজি ৩৮৮), কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ (বিজি ৩৮৮) ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ (ইকে ৫৮৭), এমপি নুর-ই হাসনা লিলি চৌধুরী ও তার পরিবার (ইকে ৫৮৫), উত্তরা এলাকার সাবেক এমপি হাবিব হাসান (বিজি ৫৮৪) এবং জেপি প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (এসকিউ ৪৭৪) নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ ছাড়েন।
এছাড়াও পরিবারের চার সদস্য ১৬ জুলাই যান মালয়েশিয়া যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপিকা রুমানা আলী টুসি। তার সঙ্গে ছিলেন। এদিন পরিবারের চার সদস্য নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান ময়মনসিংহ-৮ আসনের এমপি মাহমুদ হাসান সুমন। চীন গেছেন কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। ১৭ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে ঢাকায় ফেরেন চট্টগ্রাম-১ আসনের এমপি মাহবুব উর রহমান। এ সময় ঢাকা-৫ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজল ভারত সফরে ছিলেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৭ জুলাই। ভোলা-৪ (চরফ্যাসন-মনপুরা) আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব দুবাই গেছেন ২৭ জুলাই। সিলেট-১ আসনের এমপি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আগে থেকেই ছিলেন আমেরিকায়। তিনি এখনও সেখানে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান ২৫ জুলাই কানাডা গেছেন। এটি তাঁর সরকারি সফর বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম-১০ আসনের এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চু ২৮ জুলাই টরন্টো থেকে ঢাকায় ফেরেন। চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি শফিকুর রহমান ১৮ জুলাই স্ত্রীসহ যুক্তরাষ্ট্রে যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এমপি ফয়েজুর রহমান ২৭ জুলাই স্ত্রীসহ পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে হংকং থেকে দেশে ফেরেন। কুমিল্লা-৩ আসনের এমপি জাহাঙ্গীর আলম সিঙ্গাপুর গেছেন ২৮ জুলাই।
ভোলা-৩ আসনের এমপি নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছেন গত ২৬ জুলাই। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পারভীন জামান গত ২৬ জুলাই ব্যাংকক গেছেন। ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন গত ২৩ জুলাই ব্যাংকক থেকে দেশে ফিরেছেন। ময়মনসিংহ-৩ আসনের এমপি নিলুফার আঞ্জুম লন্ডন থেকে গত ২৫ জুলাই দেশে ফেরেন।
শেয়ার করুন