দেশে প্রথমবারের মতো তারবিহীন চার্জিং বৈদ্যুতিক যান (কার) উদ্ভাবন করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) একদল তরুণ গবেষক।
দীর্ঘ গবেষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে যানটি উদ্ভাবন করেছেন তারা।
রবিবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে সাথে কথা হয় গবেষণা দলের প্রদান সমন্বয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতে খায়রুল আমিনের সঙ্গে।
তিনি জানান, ‘বর্তমানে দেশে ডিজেল চালিত গাড়িগুলো কমে এখন ইলেক্ট্রিক চালিত গাড়ির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের দেশে কীভাবে ওয়্যারলেস চার্জিং গাড়ি তৈরি করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যে ওয়্যারলেস চার্জিং বৈদ্যুতিক কার উদ্ভাবন করেছি সেটার আলাদা কোনো চার্জিং স্টেশনের প্রয়োজন হবে না। যানটি যে কোনো পাওয়ার স্টেশনে গেলেই কোডিং পদ্ধতিতে অটোমেটিক চার্জ হয়ে যাবে। অথবা সুইচ অন-অফের মাধ্যমেও চার্জ করা যাবে। এছাড়াও গাড়িটাতে রয়েছে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ব্যবস্থা।’
গাড়িটির কার্যক্ষমতা নিয়ে গবেষণা তিনি বলেন, ‘আমরা যে কারটি উদ্ভাবন করেছি সেটার কার্যক্ষমতা ৪০ শতাংশের বেশি। ভবিষ্যতে এটির বিস্তর গবেষণা করে কার্যক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। গাড়িটি পুরোপুরি চালু করা গেলে ওয়্যার চালিত গাড়িগুলো রিপ্লেস করে ওয়্যারলেস চার্জিং গাড়ির প্রচলন ব্যবস্থা করা যাবে।’
এই যান উদ্ভাবনের ফলে স্যাপ্লাইয়ার ও গ্রাহকের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী এ গবেষক।
এ গবেষণায় অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী মো. নাহিদ ইসলাম, মো. কবির হাসান, আজম জামান। স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রেজওয়ান জাকারিয়া, এম. রিফাত হোসেন, আবির মাহমুদ, মো. সাজ্জাদ হোসেন, মো. ইরফান উদ্দিন আহমেদ মেহেদী, মো. তৌসিফুল আলম। এই দলে মেন্টর হিসেবে রয়েছে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতে খায়রুল আমিন এবং সহকারী অধ্যাপক নাফিজ ইমতিয়াজ রহমান।
উদ্ভাবনী সম্পর্কে গবেষকরা জানান, এই বৈদ্যুতিক যানটিতে রয়েছে উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সি সম্বলিত ইনভার্টার টেকনোলজি, ব্যাটারি ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম, ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা, কিলো হার্জ রেঞ্জ রেজন্যান্ট কাপলিং, সিরিজ সিরিজ কম্পেন্সেটিং নেটওয়ার্ক, ভুল সংযোগ প্রতিরোধী টেকনিক, প্রোটেকশনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি। যানটি তৈরির পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৪০ শতাংশের বেশি কার্যদক্ষতা রয়েছে বৈদ্যুতিক এ যানটিতে। এছাড়া যানটি সফলভাবে চালাতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
উদ্ভাবনটি নিয়ে গবেষক দলের সদস্য এম. রিফাত হোসেন বলেন, আমরা যে ইলেক্ট্রিক ভেহিকেল (ই-ভি) একটি তড়িৎ চালিত বাহন উদ্ভাবন করেছি। বর্তমানে দেশে প্রচলিত যানবাহন থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা সাথে অন্যান্য গাড়ির পার্থক্য যে এটি তড়িৎ চালিত। সাধারণত ব্যাটারির ধারণকৃত চার্জকে ব্যাবহার করে এ যান কাজ করে। আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাচ্ছি, এতে সাধারণ জ্বালানি চালিত বাহনের পরিবর্তে ই-ভি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, এই প্রজেক্টটিতে আমরা ই-ভি এর চার্জিং পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছি। প্রযুক্তিটি দেশে এক নতুন যাত্রার পথচলা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমর অনেকটা পথ পেরিয়ে, কর্মক্ষম করে গড়ে তুললে এটি ভবিষ্যতে ই-ভি চার্জের পদ্ধতিকে বদলে দিতে সক্ষম হবে।
দলের আরেক সদস্য মো. কবীর হাসান বলেন, ‘এই যানটিতে রয়েছে উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সি সংবলিত ইনভার্টার টেকনোলজি; যা ২০ কিলো হার্জ আউটফুট দিতে পারে। এতে রয়েছে ব্যাটারি ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম, ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা। ট্রান্সমিটার এবং রিসিভারের ইনফুট এবং আউটফুট ম্যাচিং করার জন্য রয়েছে রেজন্যান্ট কাপলিং সিস্টেম।
তিনি আরো বলেন, তারবিহীন চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রান্সমিটার ও রিসিভার নামে দুইটি কয়েল রয়েছে। এর মধ্যে ট্রান্সমিটার কয়েলটি চার্জিং স্টেশনে এবং রিসিভার কয়েলটি গাড়িতে থাকবে। যাত্রীরা গাড়িতে বসানো থাকা অবস্থায় এটি চার্জিং করা যাবে। চার্জিং সময় বিদ্যুৎ যদি ২ অ্যাম্পিয়ার হলে ১০ ঘন্টা লাগবে ফুল চার্জ হতে। আর যদি ৫ অ্যাম্পয়ার বিদ্যুৎ থাকলে ৪ ঘন্টা লাগবে। বিদ্যুৎ পরিমাণ যত বাড়ানো যাবে চার্জিয়ের সময় তত কম লাগব বলে জানান তরুণ এ গবেষক।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জুন থেকে গবেষকরা এ যান উদ্ভাবনে কাজ শুরু করেন। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রের ডিজাইন এন্ড ইম্প্লিমেন্টেশন অব এ লাইট ডিউটি ইলেক্ট্রিক বিহিকেল ইন কর্পোরেটেড উইথ ওয়্যারলেস চার্র্জিং সিস্টেম’ নামক একটি প্রজেক্টের আওতাধীন এক বছর নাগাদ কাজ করে শিক্ষার্থীরা। ওয়্যারলেস চার্জিং বৈদ্যুতিক গাড়ি উদ্ভাবন প্রজেক্টিতে অর্থায়ন করেছে সাস্ট রিসার্চ সেন্টার। এটি পুরোপুরি চালু হলে দেশের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ার করুন