দেশে যেকোন সময় বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা

জাতীয়

দেশে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হবার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরের টেকটোনিক প্লেটে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হয়েছে। ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো তারই বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বড় ভূমিকম্প হলে পুরান ঢাকায় কোন উদ্ধার কাজ করা সম্ভব হবে না।

ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্চ, সিলেট অঞ্চলে যে টেকটোনিট প্লেটটি রয়েছে সোমবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো ঠিক সেখানে। গেলো আগস্টেও একই প্লেটের কাছাকাছি ৫.৪ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে গড়ে ৩০টি ভূমিকম্প হয়। কিন্তু গেল দুই মাসে এমন ছোট ছোট ৩৪ টি ভূমিকম্প হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান,  বলছেন, বাংলাদেশে ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে পাঁচটি। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০ থেকে ২৫০ বছর। দীর্ঘ সময় এই টেকটোনিক প্লেটে বড় কোন ভূমিকম্প হয়নি। তাই প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হয়েছে। ভূমিকম্প ফেরার সময় ধরলে, যে কোন সময় বড় ভূমিকম্প আঘাত হানার শঙ্কা আছে।

দেশে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হবার শঙ্কা রয়েছে

দেশে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হবার শঙ্কা রয়েছে

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি বলেন, গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে বড় ভূমিকম্প হয়নি।  তার মানে, ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে।

তিনি সতর্ক করে আরও বলেন, তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে৷ কয়েক হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে৷ মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বা এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রতি দেড়শ’ বছরে সাত বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই হিসাবেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশে পাঁচ দশমিক দুই মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল আসাম।

ইউএসজিএস অনুসারে, গোয়ালপাড়া থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ও গুয়াহাটির ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে উৎপন্ন ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলটি ১৮৯৭ সালের আট দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ বা এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রতি দেড়শ’ বছরে সাত বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে

বাংলাদেশ বা এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রতি দেড়শ’ বছরে সাত বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এরপরও আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এদেশে বেশ কিছু চ্যুতি রয়েছে। এর মধ্যে ডাউকি চ্যুতি খুবই সক্রিয় ও বিপজ্জনক। ডাউকি ছাড়াও দেশের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎস চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের মধ্যকার ভূ-অভ্যন্তরীণ ৬২ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত একটি সাবডাকশন অঞ্চল। এই অঞ্চলে একটি টেকটোনিক প্লেটের নিচে আরেকটি তলিয়ে যেতে থাকে এবং এই অঞ্চলজুড়ে সক্রিয় মূল চ্যুতির অনেকগুলো শাখাও রয়েছে।

ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সাবডাকশন অঞ্চলে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এত বেশি যে এটি সম্ভবত বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। মৃদু মাত্রার এই ভূমিকম্পগুলো আমাদের সতর্ক করছে… বাংলাদেশে ভূমিকম্প আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত। কিন্তু কখন আঘাত হানবে, তা আমরা জানি না। ঢাকা মহানগরীতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জাতীয় বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে নির্মিত অনেক ভবন ভূমিকম্প হলে রাজধানীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে।

এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস বলছে, বড় ভূমিকম্প হলে পুরান ঢাকায় উদ্ধার কাজ করা যাবে না। পরিত্যক্ত ঘোষনা করতে হবে। উদ্ধার কার্যক্রমের সক্ষমতা নিয়েও শঙ্কা জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমাদের খুব বেশি প্রস্তুতি নেই। সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা, যেটার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) থাকতে হয়। সেটা এখন সময়ের দাবি৷

সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এমনটা জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সেটা বাস্তবায়ন করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। যেমন ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরে আর বহুতল ভবন হবে না।  ত্রাণ ও দূর্যোগ সচিব কামরুল হাসানও জানান,  উদ্ধার তৎপরতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জম কেনা হচ্ছে।

আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, প্রতিটি দুর্যোগ থেকেই আমরা শিক্ষা নিচ্ছি৷ সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে রাতারাতি সব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা বৈঠক হয়েছে৷ একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে৷ সেই অনুযায়ী তিন ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

বাংলাদেশের ভেতরের টেকটোনিক প্লেটে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হয়েছে

বাংলাদেশের ভেতরের টেকটোনিক প্লেটে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হয়েছে

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে৷ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বেশিরভাগ ভবন মালিকই তা মানছেন না। আইন হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরও এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং ভূমিকম্পে ক্ষতির আশঙ্কা।

বুয়েটের জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে৷ এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু৷ ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *