আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না নিলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। সারাদেশের ন্যায় কুলাউড়া (মৌলভীবাজার—২) আসনটিতে নৌকার মনোনয়ন পেতে একাধিক নেতা দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ আসনের সাবেক ও বর্তমান দলছুট তিন সংসদ সদস্যর নির্বাচনের অংশগ্রহণ এবং কোন দলের প্রার্থী হবেন সেটি নিয়ে রাজনৈতিকমহলসহ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
সবদলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিবেন না এমনটি সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাস খান মুঠোফোনে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) এর প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে রয়েছেন। বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটের হয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের এক দফা দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় রয়েছেন।
এদিকে নির্বাচনে অংশ নিবেন কিনা এবং কোন দলের প্রার্থী হবেন সে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও এম এম শাহীন।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ একাধিক গণমাধ্যমে জানিয়েছেন নৌকা না পেলে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। এম এম শাহীন নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী হবেন সেটি এখনো তিনি নিশ্চিত করেননি। এদিকে কে হবেন নৌকার প্রার্থী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরে সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে চলছে জল্পনা কল্পনা।
তথ্যমতে, জোট—মহাজোটের গ্যাঁড়াকলে আর এক এগারোর সংস্কারপন্থী ঝড়ে ডিগবাজীর রাজনীতিতে জড়িয়ে কুলাউড়া আসনটিতে গত দেড় দশক থেকে সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও দুই যুগ থেকে সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। ২০০৮ সালে এ দুজন দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে এম এম শাহীন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। সুলতান মনসুর ওই সময়ে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে প্রার্থী না হলেও জাতীয় পার্টির অ্যাড. নওয়াব আলী আব্বাস খানকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রচারণা চালান। ওই সময় তার নির্বাচনী প্রচারণায় এক ভোটে দুই এমপির কথা বলে ভোট চান। হেভিওয়েট তকমা হারিয়ে দলীয় রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিলেন তারা।
২০১৮ সালে দলে ঠাঁই না পেয়ে দুজনই নিজ দলের বিপরীতে গিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হন। মনোনয়ন না পেয়ে নৌকায় চড়েন এম এম শাহীন ও দল থেকে দীর্ঘদিন নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর নির্বাচনে নামেন ধানের শীষ নিয়ে।
নির্বাচন কমিশনের তফসীল অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন দাখিলের তারিখ। সেই হিসেবে আর মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি। এ আসনে কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের মাঝি নাকি এ আসনে মহাজোটের হয়ে অন্য কোন দলের প্রার্থী।
একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, নৌকার দলীয় প্রার্থী হতে মনোনয়ন কিনেছেন ৮ জন আওয়ামী লীগ নেতা। এদিকে এবার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও এম এম শাহীন দুজনই চড়তে চান নৌকায়। যদিও তারা বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। গত নির্বাচনে একজন আরেকজনের শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। একজনের দলের প্রতীকে অন্যজন প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সুলতান মনসুরের স্লোগান ছিল জয় বাংলা জয় ধানের শীষ আর এম এম শাহীন স্লোগান দেন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
২০০৮ সাল হতে দল থেকে নির্বাসিত হয়ে সুলতান মনসুর সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী সভায় সুলতান মনসুর বিভিন্ন সভায় আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নয়, যাতনার সরকার। শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে তাহলে মাত্র ২ কোটি টাকার জন্য খালেদা জিয়াকে যে নির্জন কারাগারে রেখেছেন। তা থেকে পরিত্রাণ দিন। কারণ এটা অমানবিক। কিন্তু আপনি সেটা শুনছেন না। শুনবেন, যখন আপনি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখবেন আর কোন লোক আপনার সাথে নেই। এটা একটা সরকারি লীগ, এটা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। এটা লুটপাটের লীগ।’
নির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন তিনি। এরপর সংসদ অধিবেশনে ও এলাকায় বিএনপি ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে একাধিকবার তির্যক বক্তব্য দেন। তিনি সংসদে বিএনপির সমালোচনা করে বলেন, খুনি জিয়ার বিএনপি শুধু ষড়যন্ত্র করেই ক্ষমতায় আসতে পারে। আন্দোলনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবেনা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকে বক্তব্য দেন সুলতান মনসুর। দলের মনোনয়ন ও প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হতে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে সালাম করেন তিনি।
নির্বাচনে অংশ নিবেন কিনা জানতে চাইলে সুলতান মো. মনসুর আহমদ মুঠোফোনে বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত হলে তখনই জানতে পারবেন। এটাই শেষ কথা।
এদিকে কুলাউড়া বিএনপির সাবেক সহ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এমএম শাহীন দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার সুলতান মনসুরকে পরাজিত করেন। ২০০৮ সালেও মনোনয়ন বঞ্চিত এমএম শাহীন ফের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মহাজোটের নওয়াব আলী আব্বাস খানের কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ফের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে মহাজোটের শরীক দল বিকল্প ধারায় যোগ দিয়ে নৌকার প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বক্তব্য দেন। ওই সময় আওয়ামী লীগ আয়োজিত কর্মী সভায় তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়ানো নিজের ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেন।
গত বছর খানেক ধরে তিনি আবারো স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি নিজে ভিন্নধারার রাজনীতিতে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গান। একাধিক সমাবেশে তিনি তার দলীয় প্রতীক সুলতান মনসুর হাইজ্যাক করেছেন বলেও মন্তব্য করেন।
আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচনে এম এম শাহীন প্রার্থী হবেন সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। কিন্তু কোন দলের প্রার্থী হবেন সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি মুঠোফোনে জানান, ‘কোন দলের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে অবজারেভশনে আছি।’
শেয়ার করুন