বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে আমেরিকাকে বার্তা দিয়েছে ভারত – ভারতের সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হবার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ঠিক এরই মধ্যে নতুন করে ভারতীয় সংবাদপত্র ‘দ্য হিন্দু’-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাংবাদিক প্রণয় শর্মা জানিয়েছে যে নির্বাচনে শেখ হাসিনা হারলে বেকায়দায় পড়তে পারে ভারত। দেশটি বিভিন্ন ইস্যুতে সমস্যায় পড়বে। একইসঙ্গে আঞ্চলিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
রোববার (২০ আগস্ট) বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ সংবাদমাধ্যমটি। দ্য হিন্দুতে সাংবাদিক প্রণয় শর্মার ওই প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনা হেরে যান, তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে।
তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতা হারায় তাহলে এতে ‘চিন্তিত’ হয়ে পড়বে ভারত। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রণয় শর্মার প্রতিবেদনটির শুরুতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশিদের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে, সেখানে শেখ হাসিনার সরকার খুব সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে যদিও ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বিগ পাওয়ার’ হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এই অবস্থানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। আর বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তাদের অবস্থান শক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে এরপর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে এবং জানুয়ারিতে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচন নিশ্চিতে চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টাকারীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
প্রণয় শর্মার প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে উপকৃত হয়েছে বিরোধী দলগুলো। দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অবাধে সরকার বিরোধী সমাবেশ ও র্যালি করছে। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন— যেমন ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামিও, যেটির সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে— যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করেছে। সেই জামায়াতও গত ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বড় র্যালি করেছে।
এরপর বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আমির খসরু বলেছিলেন, ‘যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
তবে ভারতের শঙ্কা হলো—জামায়াত ও এমন সমমনা দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি বাংলাদেশে শাসন পরিচালনা করবে— এমন সম্ভাবনা ঢাকা ও দিল্লিতে সতর্কতা ও শঙ্কা তৈরি করেছে।
প্রণয় শর্মার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত এবং নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করেছেন। যা দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হয়েছে। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাদের মুসলিম-বিদ্বেষী এবং বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্যকে শেখ হাসিনা যে পাত্তা দেননি— এরমাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে শক্তিশালী ও বিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক বিদম্যান রয়েছে।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বক্তব্যে সাবের হোসেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে একটি সহযোগিতামূলক এবং নিরাপত্তামূলক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। যেই সম্পর্কে সরাসরি যোগাযোগ একটি প্রভাব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দুই পক্ষের মধ্যে একটি উইন-উইন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং দুই দেশের সরকারই উন্নতির ক্ষেত্রে একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল।
প্রণয় শর্মার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এই সম্পর্কের মাধ্যমে ভারত এমন একটি উদাহরণ তৈরি করতে সম্মত হয়েছে— যেখানে দেখা যাচ্ছে ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে প্রতিবেশীরা কীভাবে সুফলতা পেতে পারে।
এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছে। কিন্তু তা সত্বেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি ও বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এগুলো বন্ধ করেছেন।
কিন্তু ঢাকা ও নয়াদিল্লির শঙ্কা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন যে অবস্থান নিচ্ছে এতে করে বাংলাদেশ ও ভারতের এ সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কোথাও যদি তাদের কৌশলগত সম্পর্ক জড়িত থাকে তাহলে এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে কেন তারা এতটা মাথা ঘামাচ্ছে সেটির কারণ জানা উচিত।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র নৌকায় ঝাঁকুনি দিতে পারছে। বাংলাদেশ মার্কিনিদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণ বাইডেন প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে এখন বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারত ভয় পায় যদি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাহলে নয়া দিল্লিকে একটি বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু চীনের সঙ্গে বিএনপিরও ভালো সম্পর্ক আছে। ফলে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে চীনের স্বার্থে খুব বড় কোনো প্রভাব পড়বে না।
লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অভিনাশ পালিওয়াল বলেছেন, ‘ভারতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাবিরোধী পরিস্থিতিতে পড়েছেন এবং বিএনপি রাজনৈতিক মোমেন্টাম পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যদি বিএনপি নির্বাচনে জয় পায়, তাহলে এই চ্যালেঞ্জটি ভারতে জন্য আরও কঠিন হয়ে যাবে।’ সূত্র : দ্য হিন্দু
শেয়ার করুন