নেতৃত্বশূন্য হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি। রসাতলে যাচ্ছে হরতাল অবরোধসহ সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচি। এক দফা দাবিতে সারাদেশে বিএনপির হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলন চলছে। কিন্তু হবিগঞ্জে দলটির কোন শীর্ষ নেতাকেই রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জি কে গউছ কারাগারে থাকায় কার্যতঃ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে আন্দোলনে থাকা দেশের বৃহৎ এই দলটি। যার ফলে বিএনপির হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিগুলো রসাতলে যাচ্ছে। তবে জি কে গউছের কর্মী সমর্থকরা জেলার বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে জানান দিচ্ছেন তাদের অবস্থান।
জেলার শীর্ষ নেতারা এই সময়ে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ। বাকীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। যে কারণে কর্মীরা কোন নেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। হরতাল-অবরোধে নেতাকর্মীদের একদমই মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
তবে তারা কেবল ফেসবুক ও সংবাদ মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ তাদের।
এই অবস্থায় হবিগঞ্জ জেলায় বিএনপির কার্যক্রম যেমনটা হওয়া দরকার ছিল, তেমনটি হচ্ছে না স্বীকার করে জেলা বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, জি কে গউছ কারাগারে থাকায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আছে। তবে বর্তমান জেলা কমিটি আসলে জি কে গউছের অনুসারী।
কমিটিতে আহ্বায়ক আবুল হাসিমসহ অধিকাংশরাই জি কে গউছের পছন্দের লোক। সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আক্তার শিপা কেন্দ্রীয় বিএনপির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এরপরও জেলা কমিটির পদ আঁকড়ে বসে আছেন তিনি। এতগুলো পদ আকড়ে রাখা নেত্রীকে কখনো পাওয়া যায়নি হবিগঞ্জের রাজপথে। তার মতো অনেকে পদ নিয়ে বসে আছেন বিভিন্নস্থানে। অবশ্যই এখন গ্রুপিং বাদ দিয়ে একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ছিলো বলেও মন্তব্য করেন ওই যুগ্ম আহ্বায়ক।
হবিগঞ্জে বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে জেলা বিএনপি কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। বর্তমানে দু’টি গ্রুপ আলাদা হয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির কর্মসূচীগুলো পালন করছে। হবিগঞ্জ শহরে জেলা বিএনপির দুইটি অফিস রয়েছে।
শায়েস্তানগর এলাকায় জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জি কে গউছের নেতৃত্বে বিএনপির একটি অফিস চলে। আরেকটি গ্রুপ শহরের সিনেমা হল এলাকার অফিসকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করছে।
তবে জি কে গউছ সাম্প্রতিক সময়ে হবিগঞ্জে বিএনপির রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তি। তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন আন্দোলন বা কর্মসূচী পালিত হচ্ছে হবিগঞ্জে।
সম্প্রতি তিনি একটি মামলায় কারাগারে থাকায় জেলায় খুব একটা আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারেনি দলটি। গত ২৯ আগস্ট বিএনপির নেতা জি কে গউছকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। এরপর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তার সাথে কারাগারে রয়েছেন জেলা যুবদলের আহ্বায়ক জালাল আহমেদ, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শাহ রাজীব আহমেদ রিংগনসহ বেশ কয়েকজন নেতা। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে শুরু করে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে হবিগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উপস্থিতি একেবারেই চোখে পড়েনি। একই অবস্থা রয়েছে জেলার প্রায় সবকটি উপজেলাতেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাসিম এই মূহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য সুজাত মিয়া অধিকাংশ সময় যুক্তরাজ্যে থাকেন বর্তমানেও সেখানেই আছেন। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলালও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সম্প্রতি নবীগঞ্জ পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা সদস্য পৌর মেয়র ছাবির আহমেদ চৌধুরীও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ-কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আক্তার শিপা জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক হলেও তাকে কখনোই হবিগঞ্জ দেখা যায় না। এই জেলার আন্দোলন-সংগ্রামে তার কোন ভূমিকা নেই। বিএনপির এই নেতা কেন্দ্রীয় মহিলা দলের ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক, সিলেট বিভাগীয় মহিলা দলের সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের সদস্য। তিনি হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে বিএনপির একজন মনোনয়নপ্রত্যাশীও।
চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মো.সিরাজ আলী মীর বলেন, শাম্মী আক্তার শিপা আমাদের গর্ব। তিনি যদি এলাকায় আসতেন তাহলে ছাত্রদল-যুবদলসহ বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আরো উদ্বুদ্ধ হতেন। চুনারুঘাটে এই মূহুর্তে সত্যিকার অর্থে পুলিশের কারণে নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না।
এছাড়াও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া অধিকাংশ সময় যুক্তরাজ্যে বাস করেন। যে কারণে নবীগঞ্জ-বাহুবল উপজেলার নেতাকর্মীরা তাকে গত ১০ বছরেও পাশে পায়নি। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলালও চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অথচ হরতাল-অবরোধে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আহমেদ মুকিব আব্দুল্লাহ বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ থেকে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে প্রচার-প্রচারণা চালালেও তাকে কখনো রাজপথে দেখা যায়নি। তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করে জেলা বিএনপিকে দ্বীধাবিভক্ত করে রেখেছেন।
বানিয়াচং উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ বশির আহমেদ রয়েছেন আমেরিকায়।
আজমিরীগঞ্জের উল্লেখযোগ্য বিএনপি নেতা খালেদুর রশিদ ঝলক স্বপরিবারে বসবাস করেন সিলেটে। মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শিল্পপতি সৈয়দ ফয়সল ও তার পরিবার। কিন্তু তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ওই দুই উপজেলায় বিএনপি একেবারেই ঝিমিয়ে আছে। লাখাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি ডা. স্বপন চৌধুরী স্বপরিবারে ঢাকায় বাস করছেন। যে কারণে তাকেও পাশে পাচ্ছেন না স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
মাধবপুর বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলায় বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন সৈয়দ ফয়সলের পরিবার। কিন্তু তিনি নিজেও রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন। তার ভাই মাধবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো.শাহজাহানও বিএনপি নেতাকর্মী বা কর্মসূচীর কোন খোঁজ রাখেন না।
বানিয়াচং জনাব আলী ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা যুবদল নেতা সালাউদ্দিন বলেন, সভাপতি মুজিবুল হক মারুফ ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে নকিব মাখন গ্রুপিংয়ের রাজনীতি করছেন। যে কারণে উপজেলাটিতে বিএনপির কোন কর্মকান্ড নেই। যে কারণে কর্মীরা একেবারেই হতাশ।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ-হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান চৌধুরী, এডভোকেট হাজী নুরুল ইসলাম, এডভোকেট মো. এনামুল হক সেলিম, এডভোকেট কামাল উদ্দিন সেলিম, ডা. আহমুদুর রহমান আবদাল, ইসলাম তরফদার তনু, আব্বাস উদ্দিন, হাজী এনামুল হক রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও রয়েছেন এই তালিকায়।
হবিগঞ্জ জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক ও সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান আউয়াল বলেন, আমরা তো বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং কর্মসূচী পালন করছি। বিএনপির রাজনীতির সাথে কতটা যুক্ত রয়েছেন কি না জানতে চাইলে পৌর বিএনপি ও সাবেক জাসাস নেতা শাহ আলম চৌধুরী মিন্টু তার স্কুলের পুনর্মিলনী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন জানিয়ে বলেন, বিএনপিতে আছি বলেই আমার নামে মামলা হয়েছে। তাছাড়া বিএনপি নেতা ও সাবেক মেয়র আলহাজ্ব জি কে গউছ কারাগারে থাকায় হবিগঞ্জে আন্দোলনে ভাটা পড়েছে।
নবীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান সেফু বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া দেশে থাকলে নেতাকর্মীরা অনুপ্রাণিত হন। শুনেছি তিনি এক সপ্তাহ হয়েছে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন। তবে আমার সাথে তার দেখা হয়নি।
আমরা পুলিশের হয়রানীর মধ্যে দলীয় কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছি। তবে শেখ সুজাত মিয়ার ফোন নাম্বারে কল করা হলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
হবিগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি তাজুল ইসলাম চৌধুরী ফরিদ বলেন, আমি রাজপথে আছে। শহরে পিকেটিং ও মহাসড়কে অবরোধও পালন করেছি। যদি নিষ্ক্রিয় থাকতাম তাহলে নিশ্চয়ই মামলার আসামী হতাম না। আমার পর্যায়ের অনেক নেতার নামে তো মামলা হয়নি। তাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।
নিষ্ক্রিতার অভিযোগ রয়েছে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এডভোকেট এনামুল হক সেলিম বিরুদ্ধে। তিনি গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অলটারনেট মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তারপর হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদেও তিনি বিএনপির হয়ে নির্বাচন করেন।
সাবেক এই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধেও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ও জেলা বিএনপির গ্রুপিং সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি আমার অবস্থান থেকে দলের জন্য সময় দিচ্ছি। নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে হরতাল-অবরোধ সফল করতে কাজ করে যাচ্ছি। আগামীতেও দলের যেকোন দুর্দিনে অতীতের মতই পাশে থাকব। এখন আর আমাদের মধ্যে কোন গ্রুপিং নেই। হরতাল ও অবরোধ একসাথেই পালন করেছি।
জেলা শাখার আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো.মিজানুর রহমান চৌধুরী মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, ১৯ আগস্টের পর থেকে জি কে গউছসহ হবিগঞ্জের অনেক নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। মিথ্যা মামলা ও পুলিশের হয়রানীর কারণে অনেকে বিপর্যস্ত। তবে বর্তমানে আমরা পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কোন গ্যাঁড়াকলে তারা পড়তে চান না। তাই এখন শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয বিএনপিরসহ স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আক্তার শিপার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, আমরা হরতাল-অবরোধ সফল করতে দিনরাত মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। পুলিশী হয়রানীর ফলে নেতকর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে আন্দোল সংগ্রামের সময় তারা মাঠে সক্রীয় হয়ে ওঠেন। বর্তমানেও তারা মাঠে থেকে হরতাল অবরোধ সফল করে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমি হবিগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের প্রতিটি এলাকা ঘুরে ঘুরে নেতাকর্মীদের উদ্ভুদ্ধ করছি। আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।
শেয়ার করুন