পরপর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত দুই জাহাজ, চার্টার করা জাহাজে তেল পরিবহন করবে বিএসসি

জাতীয়

বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি তেলবাহী জাহাজে পরপর আগুন লাগার ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ ঘটনার পর বিএসসি বিদেশ থেকে একটি জাহাজ ভাড়া (চার্টার) করেছে। চার্টার করা এ জাহাজ দিয়ে আপাতত ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড তেল পরিবহন করবে বিএসসি।

গতকাল (৫ অক্টোবর) ভোরে এমটি বাংলার সৌরভে আগুন লেগে একজন নিহত হয়েছেন। এর মাত্র কয়েক দিন আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর এমটি বাংলার জ্যোতিতে অগ্নিকাণ্ডে তিনজনের মৃত্যু হয়।

এ দুই ঘটনায় কোনো নাশকতা হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিএসসি। বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমোডর মাহমুদুল মালেকের আশঙ্কা, ঘটনাগুলো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে ঘটানো হতে পারে।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায় বাংলার সৌরভ জাহাজের চারটি স্থানে একসাথে ফায়ারিং হয়। যেহেতু গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগার ঘটেনি। যখন জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে, ঠিক একইসময়ে পাশ দিয়ে একটি স্পিডবোটও যায়। ‘তাই আমরা ধারণা করছি, এটি নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরপর আগুন লাগার ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশকে অস্থিতিশীল করতে হয়তো কোনো একটি চক্র জ্বালানি খাতে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। এ ঘটনার সাথে কারা জড়িত সেটি বের করা অপরিহার্য। আগুন লাগার ঘটনার তদন্তে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) মোহাম্মদ ইউসুফকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

এদিকে বিএসসি ও দেশের অন্য কোনো বেসরকারি কোম্পানির কাছে উপযুক্ত জাহাজ না থাকায় আপাতত বিদেশ থেকে চার্টার করা জাহাজ দিয়ে ক্রুড তেল খালাস করবে বিএসসি।

কমোডর মালেক জানান, ৩৭ বছরের পুরনো দুই জাহাজে আগুন লাগার পর বিএসসি ইতিমধ্যে একটি জাহাজ চার্টার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু দুটি জাহাজই এখন থেকে আর তেল পরিবহন করবে না, সেজন্য আমরা অন্য দেশ থেকে ৩০ হাজার টন ক্ষমতার একটি জাহাজ চার্টার করেছি। রোববার এটি দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যে ওই জাহাজের মাধ্যমে মাদার ভেসেল থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তেল পরিবহন করবে।’

বিএসসি এমডি আরও বলেন, ‘দেশীয় জাহাজ দিয়ে তেল পরিবহন করার কারণে এই খাতে দেশের টাকা দেশেই থাকত। এখন যেহেতু চার্টার জাহাজে তেল পরিবহন হবে, তাই কারেন্সি বিদেশে চলে যাবে। বিপিসির সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প চালু না হওয়া পর্যন্ত এই চার্টার জাহাজ দিয়ে তেল পরিবহন চলবে।’

একটি জাহাজে তেল পরিবহনে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগবে কি না—এমন প্রশ্নের জাবাবে বিএসসির এমডি বলেন, বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ জাহাজ দুটির সক্ষমতা ৩০ হাজার টন হলেও ওই জাহাজেগুলোতে ১০ হাজার টনের বেশি তেল পরিবহন করা হতো না। চার্টার করা জাহাজটি দিয়ে দুই জাহাজের বেশি তেল পরিবহন করা যাবে। ফলে আগের তুলনায় সময় আরও কম লাগতে পারে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ৬ অক্টোবর তিন দিনের সফরে চট্টগ্রামে যাবেন। এ সফরে তিনি বন্দর পরিদর্শন করবেন। সফরকালে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেমন বন্দর, চলমান প্রকল্প ও সাবমেরিন ঘাঁটি পরিদর্শন করবেন।

ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি 

বিএসসি ছাড়াও বন্দরের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের পর্যন্ত সুসজ্জিত ফায়ার স্টেশন নেই। এতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি বেড়েছে।

তারা বলেন, কর্ণফুলী, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও বন্দর ফায়ার স্টেশনের দমকলকর্মীদের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করতে হয়। এছাড়া তারা চট্টগ্রামে জ্বালানি তেল পরিবহন ও মজুতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি কর্ণফুলী নদীর তীরে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেমন ইস্টার্ন রিফাইনারি, নৌবাহিনীর ঘাঁটি, তেল কোম্পানির ডিপো, টিএসপি কমপ্লেক্স, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি ও এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন বিপজ্জনক উপাদান পরিচালনা করা হয়। ১৮টি বেসরকারি ডিপো রয়েছে এখানে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর শুধু দেশের বাণিজ্যিক লাইফলাইনই নয়, কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই বন্দরের নিরাপত্তা ও অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা জরুরি।

গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো শিল্প খাতগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এই অস্থিরতাগুলো পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হচ্ছে।

সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি ও অন্যান্য কেপিআইগুলোৎ (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) আশপাশে মানুষের অবাধ চলাচল অনাকাঙ্ক্ষিত। এসবের আশপাশে একের পর এক টানেলসহ বিমানবন্দর ও বেসরকারি ডিপো তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, কোনো দেশই তেল পরিশোধনাগারের মতো স্থাপনাগুলোর পাশে এ ধরনের স্থাপনা রাখতে দেয় না, কারণ এর ফলে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে তেল পরিশোধনাগারের এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

আমিরুল হক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকবার নাশকতার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো মূলত লোকদেখানো ছিল। নাশকতার ঘটনা বারবার ঘটলেও যথাযথ তদন্তের অভাবে দোষীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’

তিনি জানান, গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো স্বতন্ত্রভাবে অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, তবে তারা বেশিরভাগ সময়ই তদন্ত কমিটিগুলোকে সম্পৃক্ত করে না।

‘আশা করছি এবার সেরকম হবে না। সব বিশৃঙ্খলাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এই দুটি বিএসসি ট্যাংকার জাহাজে আগুন লাগানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে,’ বলেন তিনি।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (সিকিউরিটি অ্যান্ড অপারেশনস) মেজর মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক টিবিএসকে বলেন, সম্প্রতি দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ড সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

তিনি জানান, বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এবং সতর্কতা জারি করা হয়েছে। অগ্নি-নিরাপত্তার জন্য দুটি টাগবোট সংগ্রহ করা হয়েছে। নৌবাহিনীর মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নিজস্ব অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু করেছে।

বিএসসির তথ্যমতে, বাংলার সৌরভ জাহাজটি ১১ হাজার ৫৫ টন তেল বহন করছিল। এতে ৪৮ জন কর্মচারী ছিলল; তাদের মধ্যে নাবিক ছিলেন ৪২ জন।

নোয়াখালীর সাদেক মিয়া নামে এক স্টুয়ার্ড অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে মারা যান। শনিবার রাত ১২:৫০ মিনিটে আগুন লাগার পর চার ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকে। কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ৪৭ জন কর্মচারীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এর আগে গত ১১ জুন ভোররাতে যমুনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানির পাম্প হাউসে আগুন লাগে। কর্মীদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে আগুন ছড়াতে পারেনি। এর আগেও ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে যমুনা অয়েল ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, পতেঙ্গায় কোনো ফায়ার স্টেশন নেই। কর্ণফুলী, ইপিজেড ও বন্দর ফায়ার স্টেশন থেকে সহায়তা পাওয়া যায়।

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘সরকারি জ্বালানি তেলের ডিপোগুলোতে যদি আগুন ধরে, তা সাধারণ পদ্ধতিতে নেভানো সম্ভব হবে না, এতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি আরও জানান, পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা—এই প্রতিটি তেল কোম্পানির পৃথক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *