পুলিশ ভরা ছাত্রলীগে

জাতীয়

পুলিশ নিয়োগে একচোখা নীতি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সুপারিশে পুলিশ বাহিনীতে দলীয়করণের অংশ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত ১১টি বিএসএস (পুলিশ) ক্যাডারে মোট ১ হাজার ৪১৭ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে সুপারিশপ্রাপ্তদের অধিকাংশই ছিল ছাত্রলীগ। নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে সুপারিশকৃত এএসপি এবং নিয়োগ পাওয়া এসআই এবং কনস্টেবলদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। তবে সেই তদন্তের অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় পদধারী, ক্যাডার এবং সক্রিয় কর্মীদের নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশকে পুরোপুরি আওয়ামীকরণ শুরু হয় প্রয়াত এইচটি ইমামের হাত ধরে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এইচটি ইমাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ পান। এর পরই তিনি পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের মিশনে নামেন। ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগের জন্য পিএসসির নিয়োগ বোর্ডকে চাপ দেন। বিষয়টি বিতর্ক হতে পারে ভেবে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করেন। ২০১৪ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর এইচটি ইমাম শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। এ পদে নিয়োগ পাওয়ার পর দলীয়করণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ২০২১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এইচটি ইমামের সুপারিশ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের।

 

পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ওসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের সময়ে যখন যেখানে পদায়নে ছিলেন দমনপীড়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গণঅভ্যত্থানে গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া একটি অংশ চাকুরিচ্যুত হলেও বড় অংশ এখনও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে বহাল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে ২৮, ২৯, ৩১, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের নির্দিষ্ট একটি অংশের নাম উল্লেখ করে পুনরায় প্রাক-চাকরি বৃত্তান্ত যাচাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২৮ থেকে ৩৭ ব্যাচ পর্যন্ত নিয়োগ পেয়ে চাকরিতে কর্মরত এবং ৪১ ব্যাচে সুপরিশকৃত প্রার্থীর সম্পর্কে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রেখে অনুসন্ধান করতে বলা হয়। নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, সচল এবং একাধিক মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ও ফেসবুক আইডি, টিআইএন (যদি থাকে), পাসপোর্ট নম্বর (যদি থাকে)। এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য অতীতে যে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন তার নাম, সেশন ও অধ্যয়নের বিষয় এবং অবস্থান বা আবাসিক হলের নাম, ওই সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য অনুসন্ধান করতে বলা হয়।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিসিএস (পুলিশ) নিয়োগের ক্ষেত্রে কার চাকরি হবে, তা নিয়ন্ত্রণে ছিলেন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ গোলাপগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ (কেজি গ্রুপ হিসেবে পরিচিত) এলাকায় বাড়ি এমন পুলিশ কর্মকর্তারা। এইচটি ইমামের সুপরিশ এসব কর্মকর্তার মাধ্যমে পিএসসির বোর্ডে মানতে বাধ্য করা হতো। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়াতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে বেশি কাজে লাগানো হয়। পুলিশ ক্যাডার নিয়োগে মেধায় নিয়োগ পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ। বাকি ৫৬ শতাংশ নিয়োগ ছিল কোটায়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধ কোটায়। এ ছাড়া জেলা কোটায় ১০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৫ শতাংশ এবং ১ শতাংশ ছিল প্রতিবন্ধী কোটায়। কোটায় অনেক সময় যোগ্য প্রার্থী না থাকলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পান ১৮০ পুলিশ কর্মকর্তা। ২০১১ সালে ২৯তম ব্যাচে ৩৫ জন, ২০১২ সালে ৩০ ব্যাচে ১৮৪ জন, ২০১৩ সালে ৩১ ব্যাচে ১৮৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ ব্যাচে ১৫৫ জন, ২০১৬ সালে ৩৪ ব্যাচে ১৪৮ জন, ২০১৭ সালে ৩৫ ব্যাচে ১১৪ জন, ২০১৮ সালে ৩৬ ব্যাচে ১১৫ জন, ২০১৯ সালে ৩৭ ব্যাচে ৯৭ জন, ২০২১ সালে ৩৮ ব্যাচে ৯৭ জন এবং ২০২৩ সালে ৪০ ব্যাচে ৭২ জন নিয়োগ পান। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সময়ে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন ১ হাজার ৩৮১ জন।

সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০০ সালে ২০তম বিসিএসে মোল্যা নজরুল, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, হারুন অর রশীদ, মো. আনিসুর রহমান, ২১তম বিসিএস বিপ্লব সরকারসহ ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ চক্রটিই গত ১৫ বছর পুলিশকে পুরোপুরি আওয়ামীকরণ করেছে। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের দমনে এ চক্র ছিল বেপরোয়া।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পুলিশ ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় যাদের চাকরি হয়েছে, এর অধিকাংশই হয়েছে এইচটি ইমামের সুপারিশে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেখিয়ে, অন্যকে নিজের বাবা সাজিয়েও চাকরি নেওয়ার অভিযোগ ছিল। এসব তখন যাচাই-বাচাই করার সুযোগ ছিল না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পিএসপির মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডার নিয়োগ সুপারিশের বিষয়ে নানা অভিযোগ শুনেছি। বিশেষ করে ভাইভা বোর্ডে পছন্দের প্রার্থীকে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া ও বিশেষ কোঠায় দলীয় লোকজনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা মনে করি, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পুলিশ ক্যাডারে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অর্থের মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, যারা চাকরি করছেন, তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *