প্রকাশ্যে বিচার: নুরেমবার্গ থেকে বাংলাদেশ

জাতীয়

জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়া রবিবার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এই বিচারকাজ দেশে এবং সারা বিশ্বকে দেখাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এইভাবে কোনো দেশের কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে সম্প্রচারের দৃষ্টান্ত আগে বিশ্বের কোথাও দেখা যায়নি। তবে ইতিহাসখ্যাত জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রায় ২০০ জন জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনেকটা প্রকাশ্যে হয়েছিল। আধুনিক কালে পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার সম্প্রচারের তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এই প্রথম বলে টেলিভিশনে শেখ হাসিনার বিচারিক কার্যক্রমের সম্প্রচারও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যেসব সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরে, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, চিলির প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশে, ক্যাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী পলপট প্রমুখ।

এদের মধ্যে ওমর আল-বশিরের বিচার হয়েছিল জাতিসংঘের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টে (আইসিসি)। আন্তর্জাতিক আদালত প্রথমে তার বিরুদ্ধে পশ্চিম সুদানের দারফুরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে গণহত্যার অভিযোগে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আন্তর্জাতিক আদালত তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা বন্ধ করে দেয়।

আফ্রিকার শাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরের বিচার হয় সেনেগালে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অন্য দেশে গঠিত আদালতে সাজা পান। পরে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।

আরব বসন্তের ঝোড়ো আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যার অভিযোগে মিসরের একটা নিম্ন আদালতে তার আজীবন কারাবাসের সাজা হয়। পরে পুনর্বিচারে তিনি মুক্তি পান।

চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিচার চলাকালে তার মৃত্যু হয়। ক্যাম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল পটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের।

এসব সাবেক সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিচার জনসমক্ষে হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে মানবতার বিরুদ্ধে বা গণহত্যার বিরুদ্ধে সমকালীন পৃথিবীতে যে বিচারটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে সেটি হচ্ছে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে সিরিজ বিচার। এই বিচারটি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ছিল না, তবু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হিসেবে সুপরিচিত।

আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে ২০০ জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ দর্শক উপস্থিত থাকতেন। সাংবাদিকদের রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিতি ছিল, ২৩টি দেশের ৩২৫ জন সাংবাদিক এই বিচারের সময় উপস্থিত থেকেছেন। পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করে সাংবাদিকদের হাতে দেওয়া হতো। প্রকাশ্য বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই নুরেনবার্গ বিচার প্রক্রিয়াটি।

যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে টেড বান্ডি, উইলিয়াম কেনেডি স্মিথ এবং ও. জে. সিম্পসনের বিচার প্রক্রিয়াও টেলিভিশনে দেখেছেন বিশ্ববাসী। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে বেন অলিভারের বিচারও সম্প্রচারিত হয়েছে টেলিভিশনে। ইসরায়েলে ১৯৬১ সালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধী আইখম্যানের বিচারও টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। ব্রাজিলের সুপ্রিম ফেডারেল কোর্ট ও সুপিরিয়র ইলেকটোরাল আদালতে অনুষ্ঠিত সব বিচার ২০০২ সালে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৭ হাজার মামলার বিচার প্রক্রিয়া ভিডিও টেপ করে সম্প্রচার করা হয়েছিল। আধুনিক কালে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার প্রক্রিয়া সম্প্রচারের ইতিহাস তাই নতুন নয়, তবে বাংলাদেশে নতুন।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম সেই নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এই প্রথম এই ধরনের বিচার প্রক্রিয়াটি কোর্ট থেকে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এর আগে এরকম কখনও ঘটেনি। বিচারের স্বচ্ছতার জন্য এই সম্প্রচার বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এতে দেশবাসী আদালতে কীভাবে বিচারটি হচ্ছে সেটা দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *