গুমের শিকার হওয়া হুম্মাম কাদের চৌধুরীর মুক্তির সময় তাকে জানানো হয়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন। তবে শর্ত রয়েছে—রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ফেরার সুযোগ নেই।’
গুমের লক্ষ্য (টার্গেট) নির্ধারণ ও নজরদারি পদ্ধতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে গুম তদন্ত কমিশন। গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুমের লক্ষ্য বা টার্গেট ব্যক্তিকে নির্ধারণের জন্য দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। প্রথমটি হলো একটি নেটওয়ার্ক-ভিত্তিক পদ্ধতি এবং আরেকটি হলো প্রভাবশালী রাজনৈতিক বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা মোতাবেক।
নেটওয়ার্ক-পদ্ধতিতে আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে অন্যদের নাম সংগ্রহ করা হয়। এভাবে একের পর এক নতুন ভুক্তভোগী চিহ্নিত হয়ে আটক হন। একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে নিরপরাধ ব্যক্তিরাও আটক হয়ে গুমের শিকার হয়েছেন।
কমিশন জানিয়েছে, এমন একটি ঘটনায় একজন ভুক্তভোগী জানান, নির্যাতনের মুখে তিনি ভেবেছিলেন তার দেওয়া নামগুলোর যথাযথ তদন্ত হবে। তবে মুক্তির পর তিনি জানতে পারেন, তার দেওয়া একটি নামের ভিত্তিতে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি গুম হয়ে তার সঙ্গেই আটক ছিলেন। অপরাধবোধে ভুগে ওই ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তির মুক্তির জন্য আইনি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
এছাড়া, সরাসরি প্রভাবশালী বা রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যক্তিদের নির্দেশেও গুমের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত র্যাব-১১ এর সাবেক কমান্ডিং অফিসার তারেক সাঈদ মোহাম্মদ তার ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, তিনি র্যাবের তৎকালীন এডিজি অপারেশনস জিয়াউল আহসানের কাছ থেকে ‘গো-এহেড সিগন্যাল’ বা অনুমতি পেয়েই অভিযান চালিয়েছিলেন।
আরেক ঘটনায়, গুমের শিকার হওয়া ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর মুক্তির সময় তাকে জানানো হয়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন। তবে শর্ত রয়েছে—রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ফেরার সুযোগ নেই’। হুম্মাম চৌধুরীর বাবা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে ফাঁসি দেয়া হয়।
গোয়েন্দা নজরদারি
গুমের শিকারদের এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন জানতে পেরেছে, গুমের আগে নজরদারি চালাতে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো। র্যাব এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘সাইলেন্ট পিক-আপ’ বা গোপনে অপহরণ—মোবাইল নজরদারি ছাড়া সম্ভব ছিল না, কারণ এটি ভুক্তভোগীর অবস্থান সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করত।
জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের মাধ্যমে নজরদারি চালাতো জাতীয় মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি), যা ডিজিএফআই সদর দপ্তরে ছিল। ডিজিএফআই র্যাব ও ডিবিসহ অন্যান্য বাহিনীকে নজরদারি সরঞ্জাম সরবরাহ করত। ডিজিএফআইয়ের এক প্রাক্তন প্রধানও জানিয়েছেন, এনএমসি ডিজিএফআই সদর দফতরে থাকাকালীন সময়ে, তাদের সংস্থা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নজরদারি সংক্রান্ত সাহায্য প্রদান করত।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এনটিএমসি প্রতিষ্ঠার পর নজরদারি কার্যক্রম এই সংস্থার হাতে চলে এলেও, কিছু বাহিনীর কাছে এখনও নজরদারি সক্ষমতা রয়ে গেছে, যদিও এ বিষয়ে কোনো বিচারিক তত্ত্বাবধান নেই।
ভুক্তভোগীরাও তাদের অভিজ্ঞতায় জানিয়েছেন, অপহরণের আগে তাদের ওপর নজরদারি করা হয়েছিল।
যেমন একজন ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান, অপহরণকারীরা তার স্ত্রীর দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে ব্যক্তিগত একটি ফোনালাপের কথা জানত, যা থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে তার ফোন নজরদারি (ট্র্যাক) করা হচ্ছিল।
আরও কিছু ভুক্তভোগী অপহরণের আগে অস্বাভাবিক ফোন কল পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা এসব কল ধরার পর অপর প্রান্তে কেউ কোনো কথা বলত না। এসব কল সম্ভবত তাদের অবস্থান ট্র্যাক করতেই ব্যবহার করা হয়েছিল।
শেয়ার করুন