সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু করতে চেয়েছিল সরকার। প্রায় শত কোটি টাকা বাজেটের এই প্রকল্প ভেস্তে গেছে অঙ্কুরেই। প্রকল্প বাতিল হলেও ইতিমধ্যেই জলে গেছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয়েছিল হাজিরা মেশিন।
এই ক্রয়েও অভিযোগ রয়েছে জালিয়াতির। ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ। ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সে সময়ের হিসাব অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৬২০টি। এই সব প্রতিষ্ঠানে বায়োমেট্রিক হাজিরা স্থাপন করতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। এরপরই কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয় এই মেশিন। কিন্তু এরপরই করোনার দীর্ঘ সময় অফিস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
মন্থর হয়ে যায় বায়োমেট্রিক কার্যক্রম। যন্ত্রটি চালু রাখতে প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট কানেকশন ও কম্পিউটার। বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটারের অপ্রতুলতায় ভেস্তে যায় এই কার্যক্রম। এখন ব্যবহার না হতে হতে রীতিমতো জঞ্জালে পরিণত হয়েছে মেশিনগুলো। আবার যন্ত্রটির ব্যবহার না হলেও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অনলাইন চার্জের নামে হাজার হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।
প্রায় পাঁচ শতাধিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন না কিনেও গুনতে হয়েছে সার্ভিস চার্জ।
২০১৮-১৯ সালের অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী ৩২ হাজার ৫২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হয়। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৬৬ টাকা। আর বাকি বিদ্যালয়গুলো বায়োমেট্রিক হাজিরা ক্রয়ের অর্থ ফেরত দেয় বিদ্যালয়গুলো। আবার এই হাজিরা ক্রয়ের মাঝেও রয়েছে দুর্নীতির ছায়া। বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি বাজার যাচাই করে এই বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ের কথা ছিল। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে বিদ্যালয় কমিটির সভাপতির সঙ্গে যোগসাজশে জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসার অধিকমূল্য দেখিয়ে ক্রয় করেন এসব মেশিন।
এবিষয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষকরা অনেক সময় শিক্ষা অফিসে, বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ফলে বায়োমেট্রিক হাজিরা থাকলে তাদের এসব অনুষ্ঠানে যেতে সমস্যা হয়। আবার এই প্রকল্প চালুর পর পরই করোনার কারণে স্কুল বন্ধ ছিল। অনেক স্কুলে এটি দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক স্কুলে সচল থাকার পরও সেটিকে বিকল হিসেবে শিক্ষা অফিসে রিপোর্ট করা হয়।
আশেকুজ্জামান নামে একজন শিক্ষক বলেন, বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক নিয়মিত স্কুলে আসা শুরু করেছিলেন। এমনকি উপস্থিতি ও বেরিয়ে যাবার সময়ও মেনে চলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এরপর একদিন হঠাৎ বায়োমেট্রিক মেশিন ভাঙা অবস্থায় পাই। এরপর থেকে এভাবেই চলছে। এটি আর ঠিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ডিজিটাল হাজিরা নিয়ে একাধিকবার নির্দেশনাও দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. এনামুল কাদের খান স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনায় পিডিপি-৪ এর আওতায় স্লিপ ফান্ড হতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর একই বছরের জুনে উপ-সচিব আছমা সুলতানা স্বাক্ষরিত পত্রে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের লক্ষ্যে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন চূড়ান্ত করা হয়। নভেম্বরে উপ-সচিব আছমা সুলতানা স্বাক্ষরিত পত্রে জারিকৃত স্পেসিফিকেশন ও স্পষ্টীকরণের আলোকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করার জন্য বিভাগীয়- উপ-পরিচালক আহ্বায়ক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, সদস্য এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী, ১৭টি উপজেলার ১১২টি প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছিল এই বায়োমেট্রিক হাজিরা। কিন্তু বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশই বিকল হয়ে পড়ে আছে। বাকিগুলোরও ব্যবহার নেই।
বগুড়া জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বসানো হয়েছে ১০৮টি বায়োমেট্রিক হাজিরা। কিন্তু বর্তমানে বিকল অবস্থায় রয়েছে ১০২টি। বাকি ছয়টি হাজিরা মেশিনেও কোনো কাজ হয় না।
একই সময়ে এসব হাজিরা মেশিন স্থাপনেও ব্যাপক দুর্র্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। ডিজিটাল এই হাজিরা মেশিন স্থাপনে চারটি স্ক্রু ও বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে লাইন টানার জন্য কর্মী ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত।
এবিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মো. নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, এটা অনেক আগের প্রকল্প। ওই সময় যদি কেউ ক্রয় করতে চাইলে ক্রয় করেছে। যারা ক্রয় করে নাই যারা টাকা পেয়েছে তারা সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েছে। অনেক বছর আগের মেশিন তাই অনেক জায়গায় নষ্ট হয়েছে, অনেকের আবার চলছেও। অনেকেই আবার নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে কিনে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখন আস্তে আস্তে সব স্কুলে মাল্টিমিডিয়া দিচ্ছি, কম্পিউটার দিচ্ছি। তবে ডিজিটাল হাজিরা এটা শতভাগ স্কুলে দেয়া বা এগিয়ে নিয়ে যাবার আর কোনো পরিকল্পনা নেই।
শেয়ার করুন