ফুটবল বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়ছে, আর তাতেই প্রজাপতির উচ্ছ্বলতায় সিলেটের আকাশে উড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। প্রধানত ব্রাজিলের সবুজ-হলুদ-নীল আর আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদায় দ্রুতই দখল হয়ে যাচ্ছে বাংলার আকাশ। তারই মাঝে উঁকি দিচ্ছে জার্মানির কালো-লাল-হলুদ, ফ্রান্সের নীল-সাদা-লাল, স্পেনের লাল-হলুদ৷
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নেই। কিন্তু তাতে কী, বাংলাদেশে কি ক্রীড়ামোদীও নেই! আছে, আছে। আর আছে বলেই বিশ্বকাপের হাওয়া গায়ে লাগতেই চনমনে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষেরা। লেগেছে প্রাণের সাড়া।
ফেসবুকেও তার ছোঁয়া লাগলো বলে। ফেসবুকে দেখুন প্রোফাইল পিকচার পাল্টে যাচ্ছে। প্রিয় ফুটবলার কিংবা দলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে ওখানে। স্ট্যাটাসের ধরনে আসছে পরিবর্তন। নিজ দলের শ্রেষ্ঠত্ব দাবির পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে নিয়েও চলছে অবিরাম খোঁচাখুঁচি। জবাব-পাল্টা জবাব।
অথচ এই বিশ্বকাপ থেকে কত দূরেই না এখনো বাংলাদেশ!
তা না হয় হলো। তবুও সিলেটের ফুটবলভক্তরা চান, তাদের প্রিয় দল বিশ্বকাপ জিতুক। তাই তো তারা প্রিয় দলের তাদের পতাকা ওড়ান বাসার ছাদে। গায়ে তাদের জার্সি চড়ান। দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারেন আর চায়ের আড্ডায়, ফেসবুকের আখড়ায় ”যুদ্ধ” ঘোষণা করেন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে।
এই যেমন সিলেটের বালুচর এলাকায় দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নেইমারের মুখচ্ছবি; ব্রাজিলের পতাকাও। আঁকিয়ে রনিকে পাওয়া যায়নি, তবে তাঁর কথা শোনা গেছে এ আয়োজনের এক উদ্যোক্তা টুটুলের কন্ঠে, ‘‘আমরা প্রতি বিশ্বকাপের সময় দেয়ালে ছবি আঁকাই। যিনি আঁকেন, উনি ব্রাজিলের সমর্থক। তবে সব দলেরই পতাকা আঁকেন। এবার এলাকায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মিলিয়ে ১৫-২০টি স্থানের দেয়ালে পতাকা, খেলোয়াড়দের ছবি আঁকা হবে। এতে খরচ হবে ৩-৪ হাজার টাকা। তা দুই দলের সমর্থকরা মিলেই দেবো।’’
পাশে দাঁড়ানো ব্রাজিলের সমর্থক বশিরও নিজের বিশ্বাসের কথা জানিয়ে দেন অকপট, ‘‘ব্রাজিলকে ভালো লাগে, কারণ, ওরা খেলে ভালো। ৭ বছর বয়স থেকে খেলা দেখি। প্রিয় খেলোয়াড় নেই, তবে ব্রাজিলের খেলা দেখি। আশা তো করি, এবার ব্রাজিলই বিশ্বকাপ জিতবে।’’
চলছে পতাকা বিক্রি
সিলেটের অলিগলিতে এখন দেখা যাচ্ছে মৌসুমী পতাকা বিক্রেতাদের। এই যেমন গিয়াস উদ্দিন আগে রিকশা চালাতেন, চার-পাঁচ বছর ধরে চটপটি বিক্রি করেন কুলাউড়ায় । এখন পতাকা বিক্রির জন্য চলে এসেছেন সিলেটে। বললেন, এক মাস আগে অর্ডার দিয়ে রেখেছি ঢাকায় । ১৫ হাজার টাকার পতাকা কিনেছি। প্রথম দিনেই বিক্রি করেছি ২ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৬-৭-৮শ’ টাকা লাভ থাকে। ১৫ হাজার টাকা বিক্রি করলে ৭-৮-১০ হাজার টাকা লাভ হতে পারে।’’
তাঁর কাছে বেশি বিক্রি হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা।
মদিনা মার্কেট পতাকা বিক্রি করছেন আবুল কালাম। তার কাছেও কাটতি বেশি ওই দুই দেশের পতাকার। আগে সবজি বিক্রি করতেন। বিশ্বকাপ উপলক্ষে সাময়িকভাবে বদলে ফেলেছেন পেশা। বললেন, ‘‘আমরা ছয়জন মিলে ৬৬ হাজার টাকার পতাকা কিনেছি। একেকজনের পুঁজি ১১ হাজার টাকা। প্রতি দিন ৮শ’- হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে, লাভ ৪-৫শ’ টাকা। সবজি বিক্রির চেয়ে বেশি।’’
আবুল কালাম বড় পতাকা বিক্রি করছেন ১২০ থেকে দেড় শ’ টাকায়৷ আর কাঠির মাথার ছোট্ট পতাকা ১০-১৫ টাকায়। ব্রাজিলের সমর্থক কালাম জানতেন না বিশ্বকাপ শুরু হতে প্রায় সপ্তাহখানেক বাকি। শুনে সে কী উল্লাস তাঁর চোখে-মুখে! বলেন, ‘‘তাহলে তো ভালো ব্যবসা করতে পারবো সামনে।’’
নগরীর বন্দর বাজারে ফুটপাতে সারা বছরই পতাকা বিক্রি করেন শান্ত রায়। নিজেদের ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় ওসব পতাকা। বিশ্বকাপ উপলক্ষে ভালো লাভের প্রত্যাশা তাঁরও, ‘‘আমরা সারা বছরই পতাকার ব্যবসা করি। তখন বাংলাদেশের পতাকা বেশি চলে। এখন চলছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানির। প্রতি দিন প্রায় ৩০-৫০ হাজার টাকার পতাকা বিক্রি করছি। ব্রাজিলের পতাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে এবার। দ্বিতীয় আর্জেটিনা, তৃতীয়তে আছে জার্মানি। ফ্রান্স চলছে, পর্তুগালও চায় অনেকে।”
তাঁর কাছে সর্বোচ্চ ২০ ফুট দীর্ঘ পতাকা রয়েছে, যার মূল্য দুই হাজার থেকে ২২০০ টাকা। নিজে আর্জেন্টিনার সমর্থক হওয়ায় তাঁর আশা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে ফাইনালের, ‘‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা যদি ফাইনালে যায়, তাহলে আমার ব্যবসা ভালো হবে।’’
ফুটপাতের আরেক বিক্রেতা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বিক্রি করছেন জার্সি – কেবলই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার। কারণ এ দুই দলের সমর্থক বেশি। বলেন, ”প্রতি দিন ৪০-৫০ পিস করে বিক্রি হয়। আমি ১০০ টাকা করে বিক্রি করি। বেশি বিক্রি হয় আর্জেন্টিনার জার্সি।’’
এভাবেই বিশ্বকাপ জ্বর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সিলেটে।
শেয়ার করুন