বড় ধরণের ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে আছে সিলেট। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খনিজ সম্পদের এ জনপদে কোনো সময় বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর বেশ আলোচিত হচ্ছে বিষয়টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। ফলে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগ ধরে এ নিয়ে গবেষণা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোনো ভ‚মিকম্পে চাপমুক্ত হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে প্রবল চাপ জমা হয়ে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা যেমন একবারে হতে পারে, আবার কয়েকবারেও হতে পারে। তবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভ‚মিকম্প হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে সাত বা আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এখনো ধারণা নেই।’
সানফ্রানসিসকো বা দক্ষিণ আমেরিকার ভূমিকম্পের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভ‚মিকম্পের ইতিহাস রয়েছে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. রুবায়েত কবির বলেন, ‘সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পড়েছে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। দুটি চ্যুতির মাঝামাঝি এর অবস্থান। একদিকে ভারত, মিয়ানমারসহ ডাউকি চ্যুতি, অন্যদিকে রয়েছে ইউরোশিয়া চ্যুতি।
এ ধরনের অবস্থানের কারণে যেকোনো মুহূর্তে বড় ভূমিকম্প হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে। তবে এসব ভূমিকম্পের কেন্দ্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের আসাম মিজোরাম ত্রিপুরা বা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মিয়নমারে হয়ে থাকে।’
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্পের অতীত রেকর্ড ভয়াবহ। এই অঞ্চলে ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্প হয়। যেখানে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। এর কেন্দ্র ছিল মেঘালয়।
১৯১৮ সালের ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৬, যার উৎপত্তি ছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। ১৯২৩ সালে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ১, যার উৎপত্তি মেঘালয় রাজ্যে। ১৯৩০ সালের ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ১ এবং ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫।’
সিলেট অঞ্চলে এ মুহূর্তে ভূমিকম্প হলে ভয়াবহতা কেমন হতে পারে জানতে চাইলে সিলেটের সিনিয়র এই আবহাওয়াবিদ জানান, ‘এখানে দেখার বিষয়, ভূমিকম্পের কেন্দ্র কোথায় হবে? কারণ ২০২০ সালে সিলেট অঞ্চলে কয়েক দফা ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এসব ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩। কিন্তু পুরো সিলেট অঞ্চলে ঘরবাড়ি কেঁপে উঠেছিল। গভীর রাতে ভূমিকম্পের সময় মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘সিলেট উপশহর থেকে খাদিমগর পর্যন্ত এমনকি অনেক বাসাবাড়ি করা হয়েছে। এগুলোতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। সিলেটের যেকোনো স্থানে উৎপত্তি হলে ৩ তীব্রতার ভূমিকম্পেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে সিলেট নগরী।’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। কোনো উঁচু ভবন বা সাধারণ বড় অগ্নিকান্ডে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কোনো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসে নেই। ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। ভূ-তত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘পৃথিবীর ভ‚পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।’
শেয়ার করুন