আবেগ অনুভূতির সাথে মিশে থাকা একটি জনপদ- বদর! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে স্থানে মুসলমানদের বিজয় দান করেছিলেন। এটি ছিলো কাফের মুশরিকদের সাথে প্রথম যুদ্ধ। হক্ব আর বাতিলের চূড়ান্ত মোকাবিলা। মুসলমানদের জন্য ছিলো বড় একটি চ্যালেঞ্জ এবং কঠিন পরীক্ষা। বদরের সফলতা কিয়ামত পর্যন্ত মু’মীনদের প্রেরণার উৎস হয়ে অম্লান রবে, ইনশা আল্লাহ।
ইবনে ইসহাক, মুসা ইবনে উকবা ও আবুল আসওয়াদ (র.) একমত যে, যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিলো দ্বিতীয় হিজরীর রামাদ্বান মাসে। ইবনে আসাকির বলেন, দিনটি ছিলো জুমুয়ার দিন। একটি বর্ণনায় এসেছে, সেদিন ছিলো সোমবার। তবে তা দুর্লভ বর্ণনা। অধিকাংশদের মতামত যে, সতেরো তারিখ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। যদিও বারো তারিখের বর্ণনাও পাওয়া যায়। সমন্বিত কথা হলো, মদীনা থেকে বের হওয়ার সূচনা হয়েছিলো বারো তারিখ, আর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো সতেরো তারিখ। [সীরাতুন নবী সা.]।
মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া হঠাৎ এ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় নি। বরং কিছু বাস্তব কারণে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে গিয়েছিলো। যেমন: ১. মক্কার কুরাইশদের ঈর্ষা ২. মদিনায় ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা ৩. বাণিজ্যপথ রুদ্ধ হওয়ার আশংকা ৪. কুরাইশদের দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ ৫. নাখলার খন্ডযুদ্ধ ৬. আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার ৭. আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ওহী প্রেরণ।
বদর যুদ্ধের কারণ সংক্রান্ত বিষয়ে আর রাহীকুল মাখতুম গ্রন্থের বর্ণনায় পাওয়া যায়: কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে অল্পের জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাকড়াও থেকে বেঁচে যায়। এ কাফেলাই সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার পথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরেকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ এবং সাঈদ ইবনে যায়দ (রা.)-কে এ কাফেলা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে উত্তর দিকে রওয়ানা করে দেন। এই দুই সাহাবী প্রথমে হাওরা নামক জায়গায় পৌঁছে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা সে স্থান অতিক্রমের সাথে সাথে সাহাবাদ্বয় দ্রুতবেগে মদীনায় ছুটে গিয়ে এ সম্পর্কে রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করেন।
এ কাফেলা এক হাজার উটের পিঠে মক্কাবাসীদের কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার দীনার দু’শ সাড়ে বাষট্টি কিলোগ্রাম সোনার সমমূল্যের বিভিন্ন ব্যবসায়িক জিনিসপত্র ছিলো। অথচ এ কাফেলার রক্ষণাবেক্ষণে ছিলো মাত্র ৪০ জন লোক। মদীনাবাসীদের জন্য এটা ছিলো এক সুবর্ণ সুযোগ। পক্ষান্তরে এসব জিনিস থেকে বঞ্চিত হওয়া মক্কাবাসীদের জন্য সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি হয়ে দেখা দেবে। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ঘোষণা করলেন, কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা বহু সম্পদ নিয়ে আসছে। তোমরা এ কাফেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ো। হতে পারে, আল্লাহ তায়ালা সমুদয় সম্পদ তোমাদের গনীমত হিসাবে প্রদান করবেন।
ঘোষণা প্রচার করা হলেও এতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয় নি। কেননা ঘোষণার সময় ধারণা করা যায়নি, কাফেলার পরিবর্তে বদর প্রান্তরে কোরায়শ বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে। এ কারণে বহুসংখ্যক সাহাবী মদীনায়ই থেকে যান। তারা মনে করেছিলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই অভিযান অতীতের অভিযানসমূহের মতোই হবে। তাই এ যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেনি, তাদের সমালোচনাও করা হয় নি।
কোনো বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য সংখ্যাধিক্য জরুরী নয়। বদরের প্রান্তর, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কাফের মুশরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো এক হাজার। সর্বোচ্চ প্রস্তুতি সহকারে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরীর মতে, প্রথম দিকে মক্কী বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিলো তেরোশ। তাদের কাছে একশ ঘোড়া এবং ছয়শ বর্ম ছিলো। উটের সংখ্যা ছিলো অনেক, সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয় নি। এ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলো আবু জাহল ইবনে হিশাম। কোরায়শদের নয় জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এ বাহিনীর খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব নেয়। একদিন নয়টি, অন্যদিন দশটি উট জবাই করা হতো। [আর রাহীকুল মাখতুম]। অপরদিকে মুসলিম বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা কত ছিলো? কারো মতে, ৩১৩ জন। কারো মতে, ৩১৪ জন। আবার কারো মতে, ৩১৭ জন।
হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবীগণ আলোচনা করছিলাম, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সংখ্যা ছিলো তালূতের সাহাবীদের সমান। যারা তাঁর সাথে (জর্ডান) নদী পাড়ি দিয়েছিলেন। তাদের সংখ্যা ছিলো তিন শত দশের একটু বেশী। [বুখারী: ৩৯৫৮; তিরমিযী: ১৫৯৮]। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সংখ্যা ছিলো জালূত যুদ্ধে তালূতের সাহাবীদের সমান। তাদের সংখ্যা ছিলো তিন শত সতেরো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর তিন শত পনেরো জন সাহাবী নিয়ে (অভিযানে) বের হন…। [আবু দাউদ: ২৭৪৭; বায়হাকী: ৯/৫৭]।
ঈমানী দৃঢ়তা, আল্লাহর উপর ভরসা, যথাযথ আনুগত্য এবং তাঁর সাহায্যই সফলতার দ্বার উন্মোচিত করতে পারে; কোনো সন্দেহ নেই। হযরত আলী (রা.)- এর বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তিনি বলেন: ঐ রাতে অর্থাৎ যে রাতের পর সকালবেলা বদর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো, আমাদের উপর হালকা বৃষ্টি নেমে আসে। বৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত থাকার উদ্দেশ্যে আমরা গাছ ও ঢালের নিচে আশ্রয় নিই। এদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর রবের নিকট দোয়া করতে সারা রাত কাটিয়ে দেন। তিনি (দোয়ায়) বলছিলেন: হে আল্লাহ! তুমি যদি এ দলটিকে ধ্বংস করে দাও, তাহলে তোমার গোলামী করার জন্য আর কেউ থাকবে না। ফজরের সময় তিনি আল্লাহর বান্দারা সালাত! বলে লোকদের ডাকেন। ডাক শুনে লোকজন ঢাল ও গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলে, নবী (সা.) আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন এবং যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) মুশরিকদের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তাদের সংখ্যা হাজার খানেক। আর তাঁর সাহাবীদের সংখ্যা তিন শত উনিশ। এরপর আল্লাহর নবী (সা.) কিবলামুখী হয়ে নিজের হাতদুটি প্রসারিত করেন এবং নিজের রবের কাছে এভাবে মিনতি পেশ করতে থাকেন: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, তা পূরণ করো। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যার ওয়াদা দিয়েছিলে, তা আমাকে দাও। হে আল্লাহ! তুমি যদি ইসলামের এ ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস করে দাও, তাহলে তোমার গোলামী করার আর কেউ থাকবে না।
কিবলামুখী হয়ে দু’হাত প্রসারিত করে তিনি নিজের রবের কাছে এভাবে মিনতি পেশ করতে থাকেন; একপর্যায়ে তাঁর দু’কাঁধ থেকে চাদরটি পড়ে যায়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এসে চাদরটি নিয়ে তাঁর কাঁধের উপর রেখে দেন। তারপর তাঁকে পেছন থেকে ধরে বলেন: হে আল্লাহর নবী! আপনার রবের কাছে যে মিনতি পেশ করেছেন, তা আপনার জন্য যথেষ্ট; তিনি আপনাকে যার ওয়াদা দিয়েছেন, অচিরেই তিনি তা আপনাকে দেবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেন: আর স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পর পর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করছি’। [৮. সূরা আনফাল: ৯]। এ আয়াতের তাফসীর: এই যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। পক্ষান্তরে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এর তিনগুণ (এক হাজারের মত)। মুসলিমরা ছিলো খালি হাতে অন্য দিকে কাফেরদের নিকট ছিলো পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র। এই অবস্থায় মুসলিমদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন মহান আল্লাহ। তারা কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। নবী (সাঃ) নিজে অন্য এক তাঁবুতে অত্যন্ত কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট দোয়া করছিলেন। (বুখারী: যুদ্ধ অধ্যায়) সুতরাং মহান আল্লাহ দোয়া কবুল করলেন এবং এক হাজার ফিরিশতা একের পর এক মুসলিমদের সাহায্যে পৃথিবীতে নেমে এলেন। (এটি হল প্রথম পুরস্কার।) [তাফসীরে আহসানুল বায়ান]। আল্লাহ তাঁকে ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন। [মুসলিম: ১৭৬৩]।
মুসলমানদের অনেক দুর্যোগের দিনে ফেরেশতারা সাহায্য করেছেন। কিন্তু বদরের মতো আর কোনো দিন তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি। অন্যান্য যুদ্ধে তারা সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও রসদ যুগিয়ে সাহায্য করতেন। কিন্তু অসি চালনা করতেন না। [সীরাত ইবনে হিশাম]। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে একজন মুসলিম তার সামনে থাকা মুশরিককে তীব্রবেগে ধাওয়া করেন। এমন সময় তিনি তার উপরের দিকে আচমকা একটি আওয়াজ শুনতে পান। অশ্বারোহী আওয়াজ করে বলছে, হাইযূম! (ফেরেশতাকে বহনকারী ঘোড়ার নাম) সামনে চলো। এরপর তিনি তার সামনের মুশরিকের দিকে তাকিয়ে দেখেন, সে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছে। তার দিকে নজর দিয়ে দেখেন- তার নাক ভেঙে গিয়েছে, চেহারা কেটে গিয়েছে। যেন কেউ চাবুক দিয়ে তাকে আঘাত করেছে, এবং তার পুরো চেহারা নীল হয়ে গিয়েছে। ঐ আনসার সাহাবী এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এ ঘটনা জানালে, তিনি বলেন: তোমার কথা সত্য। সেটি ছিলো তৃতীয় আসমান থেকে পাঠানো লোকবলের অংশ। (মুসলিম: অধ্যায়- জিহাদ। হাদীস নং: ১৭৬৩)। [সীরাতুন নবী]।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ঐদিন যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। সীরাতুন নবী গ্রন্থে উল্লেখিত হযরত আলী বিন আবী তালিব (রা.)-এর বর্ণনা থেকে তা পরিস্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়। তিনি বলেন: বদর যুদ্ধের সময়কার কথা। আমরা তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে। আমাদের মধ্যে তিনি ছিলেন শত্রু বাহিনীর সবচেয়ে কাছে। সেদিন রণশক্তির দিক দিয়ে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে। (সুবহানাল্লাহ)
বদরের প্রান্তরে শাহাদাতের তামান্না নিয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন এবং ১৪ জন সাহাবীর শাহাদাতবরণ; আজও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ তায়ালার গোলাম ও রাসুলের (সা.) উম্মতদের মাঝে ভবিষ্যতেও উদ্দীপনা জারি রাখবে। ইনশা আল্লাহ। হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন হারিসা ইবনে সুরাকা (রা.) শহীদ হন। বয়সে তিনি একেবারে তরুণ ছিলেন। তার মা নবী করীম (সা.)-এর কাছে এসে বলেন: হে আল্লাহর রাসুল! হারিসা আমার কতো প্রিয়, তা তো আপনি জানেন। সে যদি জান্নাতে থাকে, তাহলে আমি সবর করবো এবং আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান চাইবো। আর যদি ভিন্ন কিছু হয়, তাহলে আমি কী করছি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এ কথা শুনে নবী করীম (সা.) বলেন: তোমার কী হলো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? জান্নাত কি মাত্র একটি? জান্নাতের সংখ্যা অনেক! সে তো (সর্বোচ্চ জান্নাত) জান্নাতুল ফিরদাউসে আছে। [বুখারী; অধ্যায়- যুদ্ধবিগ্রহ: ৩৯৮২]।
ইবনে ইসহাক বলেন, আমি আসিম ইবনে উমার ইবনে কাতাদা (র.) আমাকে বলেছেন: আউফ ইবনে মালিক (রা.) (মায়ের নামের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে) যাকে হারিস ইবনে আফরা নামেও ডাকা হতো- জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! বান্দার কোন কাজে খুশি হয়ে আল্লাহ হাসেন? নবী করীম (সা.) বলেন: বর্ম ছাড়াই শত্রু বাহিনীর ভেতরে ঢুকে পড়া। এ কথা শুনে তিনি নিজের গায়ে জড়ানো বর্মটি খুলে ছুঁড়ে ফেলেন, তারপর তরবারি হাতে নিয়ে শত্রুর সাথে লড়াই শুরু করেন এবং (সেখানেই) শহীদ হন (আল্লাহু আকবার)। [সীরাত ইবনে হিশাম]।
বদর যুদ্ধের ব্যাপারে বিস্তারিত আরও জানার জন্য কুরআন মাজীদের ৮ম সূরা আনফাল ভালোভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কেননা এ সূরার অধিকাংশ বর্ণনা এ সংক্রান্ত। কেউ কেউ এটাকে সূরা বদরও নাম দিয়েছেন। [বুখারী: ৪৮৮২] কারণ, অধিকাংশ আলোচনা ছিলো বদর যুদ্ধের। আবার কেউ কেউ এ সূরাকে সূরা ‘জিহাদ’ নামেও অভিহিত করেছেন। সূরা আল-আনফাল সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। [বুখারী: ৪৬৪৫, মুসলিম: ৩০৩১]।
হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোনো বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন অবিচল থাকবে আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারো। [৮. সূরা আনফাল: ৪৫]। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমগণকে যুদ্ধক্ষেত্র এবং শত্রুর মোকাবেলার জন্য এক বিশেষ হেদায়াত দান করেছেন। তন্মধ্যে প্রথম হচ্ছে, দৃঢ়তা অবলম্বন করা ও স্থির-অটল থাকা। মনের দৃঢ়তা ও সংকল্পের অটলতা উভয়টিই এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় হচ্ছে, আল্লাহর যিকর। আল্লাহর যিকর-এ নিজস্বভাবে যে বরকত ও কল্যাণ রয়েছে, তা তো যথাস্থানে আছেই, তদুপরি এটাও একটি বাস্তব সত্য যে, দৃঢ়তার জন্যও এর চেয়ে পরীক্ষিত কোনো ব্যবস্থা নেই। সুতরাং দৃঢ়পদ থাকা ও আল্লাহর যিকর এ দুটি বিজয়ের প্রধান কারণ। [সা’দী; আইসারুত তাফসীর]।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো। পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। [৮. সূরা আনফাল: ৪৬]। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে আহসানুল বায়ানের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তৃতীয় আদব হলো: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে। এটা একেবারে স্পষ্ট কথা যে, এই শোচনীয় অবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের অবাধ্যাচরণে বড় ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে। এই জন্য প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এহেন অবস্থায় বরং প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করা আবশ্যক। তথাপি যুদ্ধের ময়দানে তাঁদের আনুগত্য করা আরো অধিকরূপে আবশ্যক হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় সামান্য অবাধ্যাচরণও আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চতুর্থ আদব হলো: কোনো বিষয় নিয়ে আপোসে ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ করবে না। কারণ এরূপ করলে তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে। আর তোমাদের শক্তি চূর্ণ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। পঞ্চম আদব হলো: ধৈর্যধারণ করবে। অর্থাৎ, যত বড়ই বিপদ বা কঠিন কষ্টের সম্মুখীন হও না কেন, ধৈর্যচ্যুত হবে না। নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘‘হে লোক সকল! শত্রুদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো না, বরং তা হতে আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা চাও। পরন্তু যদি শত্রুদের সাথে লড়াই শুরু হয়েই যায়, তাহলে সবর কর (অর্থাৎ, বিচলিত না হয়ে লড়াই কর)। আর জেনে রাখো, জান্নাত তরবারির ছায়ার নিচেই আছে।’’ [সহীহ বুখারী; অধ্যায়: জিহাদ]।
[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]
শেয়ার করুন