বিবিএ শিক্ষার্থীদের ব্যবসার প্রকারভেদ পড়ানোর সময় পার্টনারশিপ বিজনেস সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়। কেতাবি আলোচনা শেষে তাদের সাধারণত একটা গল্প বলি। সেটা হলো…
এক লোক সরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসরে গেছেন। পেনশনের বেশকিছু টাকা একসঙ্গে পেয়েছেন। তখন তার এক বাল্যবন্ধু আসেন ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে। তখন সদ্য অবসরে যাওয়া ব্যক্তি বলেন, ‘আমি সারা জীবন চাকরি করেছি। ব্যবসার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। ফলে ব্যবসা শুরু করলেও সেটা তো ঠিকভাবে চালাতে পারব না।’
তখন সেই হবু অংশীদার বলেন, এটা কোনো ব্যাপারই না। আমার জীবনে বহু ব্যবসার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আপনার টাকা আর আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যবসা করলে শুধু লাভ আর লাভ। অল্প দিনে আমরা অনেক টাকা কামাতে পারব। বেচারা সহজ-সরল মানুষ। বন্ধুর কথায় রাজি হন।
ব্যবসা শুরুর বছর খানেক পরে তার এক আত্মীয় জিজ্ঞাসা করল—আপনার ব্যবসার কী অবস্থা? তখন তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আগে তার ছিল অভিজ্ঞতা আমার ছিল টাকা। এখন তার হয়েছে টাকা আর আমার হয়েছে অভিজ্ঞতা!
প্রবীণদের এক আড্ডায় গল্পটা বলামাত্র এক রসিকজন বলেছিলেন, জীবনে অংশীদারি ভিত্তিতে বিয়ের কথা ভাবলেও ভাবতে পারেন, কিন্তু ব্যবসার কথা ভাববেন না!
পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের এমন উপদেশে আমরা বিরক্ত হই। তারা আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতা সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করায় দোষারোপ করি। তাছাড়া তাদের প্রায় সবকিছুতেই খুঁত ধরার স্বভাব ভালো লাগে না। এমনকি অনেক তরুণ আজকাল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তাদের এড়িয়ে চলা পছন্দ করে। যেমন ধরা যাক…
পরস্পরকে ভালোবেসে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উভয় পরিবারও তাতে সম্মত। ফলে ব্যাপারটা রীতিমতো ‘সোনায় সোহাগা’ বলা যায়। কিন্তু সেখানে কাবিন করার সময় হঠাৎ দেখা গেল ছেলের এক অভিভাবক কাবিননামায় টাকার অংক নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে। তখন কন্যাপক্ষ তো বটেই, এমনকি বরের আসনে বসা প্রেমিক পুরুষও বিষয়টিতে বিরক্ত হয়।
সে ভাবতে থাকে…আমরা পরস্পরের জন্য জীবন দিতে পারি! সেখানে ‘কিছু টাকা’র জন্য এমন হরিষে বিষাদ করার কোনো মানে হয়? মনে মনে আরো ভাবে, আমরা তো একজন আরেকজনের জন্য দিওয়ানা। আমৃত্যু পরস্পরকে ভালোবেসে যাব। সেখানে টাকার পরিমাণ নিয়ে এমন ‘ঝামেলা’র দরকার কী বাবা?
অনেক সময় চোখ রাঙিয়ে তাদের থামিয়েও দেয়া হয়, কিন্তু বিয়ের বছর খানেক না পেরোতেই অনেকের পক্ষে আর এক ছাদের নিচে থাকা সম্ভব হয় না। তখন সেই কাবিনের টাকার অংক অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়! হয়তো ভাবছেন, তেমন আবার হয় নাকি? কেন, শাকিব খান আর বুবলির বিয়ের সময় পারস্পরিক ‘আস্থা’র কোনো ঘাটতি ছিল নাকি?
ছোটবেলায় দেখতাম সামান্য আয়োজনেও পরিবারের কর্তাদের মাঝে এক ধরনের টেনশন কাজ করত। সম্পত্তি কেনাবেচা কিংবা বিয়েশাদির মতো বড় অনুষ্ঠানে তো বটেই, এমনকি বাড়িতে মিলাদ পড়ানোর মতো সীমিত আয়োজনেও সবকিছু সুষ্ঠুভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা উদ্বিগ্ন থাকতেন। তরুণরা এমন আচরণের সমালোচনা করত। কারো কারো ক্ষেত্রে আমরা ভাবতাম, তিনি অযথা টেনশন করতে পছন্দ করেন!
কিন্তু অতিসামান্য এক ভুল বা তুচ্ছ ঘটনাও যে পুরো আয়োজনকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে, পরিবারের মান-সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তখন সেটা আমাদের মাথায় আসত না। তারা সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেগুলো শিখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। ফলে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর তারা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তেন।
জীবনে চলার পথে কিছু মানুষকে বিশ্বাস করতেই হয়। এ কিছুর মধ্যে আবার অগ্রাধিকার পায় বন্ধুরা। অনেক সময় আমরা তাদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করি, সব সিদ্ধান্ত সমর্থন করি। বিশেষত কিশোর ও তরুণ বয়সে এ প্রবণতা থাকে খুব বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো তখনকার বন্ধুত্বগুলো থাকে নিখাদ ও নিঃস্বার্থ। পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা থাকে স্পষ্ট। আমিও জীবনে অনেক বন্ধুর তেমন আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ চিত্র বদলাতে থাকে। বিশেষত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় অংশীজন হওয়ার পর সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরে। বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে নিঃশর্ত বিশ্বাস থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। আসলে জগতে নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের জন্য কাজ করা খুব কঠিন। এমনকি শুরুতে তেমন মানসিকতা থাকলেও অর্থের সংশ্লিষ্টতায় একপর্যায়ে অনেকেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখন ‘বিশ্বাস’-এর কেউ মূল্য দেয় না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, দুনিয়ার কোনো অংশীদারি উদ্যোগই অচেনা বা কম পরিচিত মানুষের সমন্বয়ে হয় না। বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে সাধারণত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়েই উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়।
কোনো পার্টনারশিপ বিজনেস যুগের পর যুগ টিকে থাকার দৃষ্টান্ত বিরল। অগত্যা টিকিয়ে রাখতে হলেও প্রতিনিয়ত নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। অধিকাংশ এমন উদ্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটে মারাত্মক তিক্ততার মাধ্যমে।
তাছাড়া সাম্প্রতিককালে মানুষ কেন যেন অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। তারা নীতি-নৈতিকতা-বিশ্বাস-আস্থা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, সহকর্মী, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ‘স্বার্থসচেতনতা’ ব্যাপক বাড়ছে।
সবাই চালাক হয়ে যাচ্ছে। নিজে জিততে গিয়ে অন্যেরা ঠকে যাচ্ছে কিনা সে ব্যাপারটা কেয়ার করছে না। ফলে বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে মনঃকষ্ট বাড়ছে। মাত্রা অতিক্রম করলে তা কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
ডেনমার্কে যাওয়ার পর এক অজ্ঞাত কারণে আমার ল্যাপটপে ওয়াই-ফাই কানেক্ট হচ্ছিল না। ডরমিটরি ও ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে একই অবস্থা। তখন আমাকে পরামর্শ দেয়া হলো কম্পিউটার সেবাদানকারী এক প্রতিষ্ঠানে যেতে।
সেখানে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক লম্বা এক ফরম পূরণ করলেন। কথা শেষে তিনি সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন স্বাক্ষর করার জন্য। জিজ্ঞাসা করলে বললেন, তিনি আমার কাছ থেকে কোন কোন ডিভাইস নিলেন, যে যে সেবা দেবেন তার বর্ণনা এবং মজুরি উল্লেখ করা আছে সে চুক্তিপত্রে!
আমাদের কালচার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন হওয়ায় সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমাদের দেশে এমন কত কিছু আমরা ‘বিশ্বাস’ করে সেবা দানকারীদের দিয়ে আসি। মজুরি বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা থাকে না। এমনকি স্লোভেনিয়ায় থাকাকালে এক দাঁতের ডাক্তারের কাছে দীর্ঘমেয়াদি সেবা নিতে গেলে তিনি এমন এক চুক্তির কথা বলেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা আমার নেয়ার দরকার হয়নি।
সেসব দেশে বাড়ি ভাড়া, কোনো সেবাপণ্যের সাবস্ক্রিপশন (ইন্টারনেট সংযোগ, কেবল টিভি, কিস্তিতে আইফোন কেনা ইত্যাদি) সবকিছুতে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। পরবর্তী সময়ে বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। সম্ভবত তারা ধাপে ধাপে ঠেকে তবেই এ পদ্ধতিগুলোর উদ্ভাবন করেছে। তাছাড়া এত উন্নত ও ‘সভ্য’ লোকদের কথায় কথায় এত চুক্তি করার দরকার হতো না।
আমরাও আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি। ফলে মানুষের লোভের মাত্রা বাড়ছে। আসলে গরিব মানুষ দুর্নীতি করে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য। আর সম্পদশালীরা সেটা করে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ কিংবা বেগমপাড়ায় স্থায়ী হওয়ার জন্য।
তাই গরিবের পেটের সীমা থাকলেও ধনীদের আকাঙ্ক্ষার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ফলে নগরজীবনে শিক্ষিত ও সম্পদশালীদের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস দ্রুত নির্বাসনে যাচ্ছে। অনেকে নিজে ঠকে বাকিরা অন্যদের দেখে শিখছে।
তাই জীবনে বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে শুধু আবেগকে প্রশ্রয় না দেয়া ভালো। কিছুটা বিরক্তিকর মনে হলেও বড়দের পরামর্শ নিন। অন্তত একজন মেন্টর রাখুন। আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলো মাথায় রাখুন।
মুখের কথায় আস্থা রাখার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়ছে। কারণ যিনি কথা দিচ্ছেন তার অনুপস্থিতিতে অন্যরা সেটা সম্মান নাও করতে পারে। এমনকি তিনিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিগড়ে যেতে পারেন। তাই যৌক্তিক, আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য ও লিখিত সিদ্ধান্ত নিন। কারো মুখের কথায় আস্থা রেখে পরে আফসোস করার চেয়ে শুরুতে ‘মন খারাপ’ করা সবার জন্যই কল্যাণকর।
যা হোক, শেষ করি ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মাধ্যমে। ক’বছর আগে সীমিত আয়োজনের এক অনুষ্ঠানে তখন মজার পর্ব চলছিল। সেখানে পারফর্ম করার জন্য হঠাৎ আমাকে ডাকা হয়। তখন বিয়ে প্রসঙ্গে বেশ ক’জন খ্যাতিমান দার্শনিক, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলাম।
সবাই খুব হাসাহাসি করল। সামনের সারিতে বসা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হঠাৎ আমাকে বললেন, ব্যবসার একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তুমি বিয়ে বিষয়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাছাড়া সেখানে প্রায় সব অতিথি সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। তাই ভারসাম্য বজায় রেখে জবাব দেয়া জরুরি ছিল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললাম, বিয়ে এমন এক পার্টনারশিপ বিজনেস যেখানে উভয় পক্ষই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে!
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী দুজনই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সংসারের জন্য সারা জীবন গাধার খাটুনি খেটে গেলাম অথচ সামান্য স্বীকৃতিটুকুও পেলাম না। ডিনার শেষে বিদায় বেলায় ভদ্রলোক উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে আমাকে বুঝিয়েছিলেন, কথাটা তার মনে ধরেছে!
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২।
শেয়ার করুন