বন্ধুরাই নেচেগেয়ে পিটিয়ে হত্যা করে শাহাদাতকে!

জাতীয়

চট্টগ্রামে যুবক শাহাদাত হোসেনকে বেঁধে গান গাইতে গাইতে পেটানোর পর তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে ভিডিও পাঠিয়েছিল হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা। চেয়েছিল মুক্তিপণ। দিয়েছিল হত্যার হুমকি। ভয়ে এ নিয়ে প্রায় দেড় মাস মুখ খোলেননি শারমিন আক্তার। অবশেষে তিনি জানালেন, বন্ধুরাই শাহাদাতকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে।

গত রোববার নেচেগেয়ে নৃশংসভাবে মারধরের ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এর পর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে মাঠে নামে পুলিশ। তবে এখনও তাদের ধরতে পারেনি।

শাহাদাত-শারমিন দম্পতির সন্তান ছিল না। শারমিন এখন সন্তানসম্ভবা। অনাগত সন্তানের মুখ আর দেখা হলো না শাহাদাতের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শাহাদাতকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় দেশজুড়ে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।

জড়িত তিনজনের নাম  হলো– লালখান বাজার এলাকার সোর্স দুলালের ছেলে সাগর, দুই নম্বর গেটের ইয়াছিন ও শান্ত। শাহাদাতের পরিবারের দাবি, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাগর শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাওনা টাকা নিয়ে তার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের আগে বিরোধ হয়। এর জের ধরে তাঁকে ডেকে নিয়ে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, শাহাদাতের পরনে নীল রঙের টিশার্ট ও ছাই রঙের প্যান্ট। পায়ে স্পোর্টস স্যান্ডেল। নগরের দুই নম্বর গেট গোলচত্বরে ট্রাফিক পুলিশের ছাউনির স্টিলের খুঁটির সঙ্গে দুই হাত বাঁধা। আধমরা শাহাদাত শরীরের ভার বহন করতে না পেরে পেণ্ডুলামের মতো দুলছিলেন। তাঁকে ঘিরে ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’ শিরোনামের গান গেয়ে নাচছিল সাত যুবক। পেছনে একজনের হাতে লাঠি। তাদের একজন ভিডিও করছিল। ভিডিওতে মুখে চাপদাড়ি, পরনে খয়েরি টিশার্ট ও কালো জিন্স পরে যাকে গান গেয়ে নাচতে দেখা যায়, সে সাগর।

শাহাদাত হোসেনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী থানাধীন পাঁচবাড়িয়া ইউনিয়নের নদনা গ্রামে। স্ত্রীকে নিয়ে নগরের কোতোয়ালি থানার বিআরটিসি বয়লার কলোনিতে থাকতেন।

স্বজনরা জানান, গত ১৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাগর পাওনা টাকার কথা বলে শাহাদাতকে দেখা করতে বলে। দেখা করতে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি তিনি। পরদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে ছবি দেখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন স্ত্রী শারমিন।

এ ঘটনায় গত ১৫ আগস্ট শাহাদাতের চাচা মোহাম্মদ হারুন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর তাঁকে নৃশংসভাবে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ সক্রিয় হয়।

শাহাদাত হোসেনের স্ত্রী শারমিন আক্তার জানান, সাগরের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা পেতেন শাহাদাত। তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় পাওনা টাকা নিতে ২ নম্বর গেটে যেতে বলে সাগর। এর পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। রাতে দুই দফা ফোন দিয়ে তাঁর স্বামীকে হত্যার হুমকি দেয় সাগর। প্রথম দফায় বলে, ‘তোর জামাই তোর বুকে কেমনে যায় আমি দেখব।’ দ্বিতীয় দফার ফোনে স্বামীকে ফেরত পেতে ৯ হাজার টাকা চায় বলে জানান তিনি। পরদিন সকালে বিভিন্ন থানায় ঘুরে তাঁর স্বামীর খোঁজ নেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফেসবুকে ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন তিনি। এর আগে শাহাদাতকে মারধরের ছবিও তাঁর মোবাইলে পাঠায় সাগর।

শারমিন সমকালকে বলেন, ‘সাগর আমার স্বামীর বন্ধু। তার সঙ্গে পাওনা টাকা নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। এর জের ধরে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে। আমার স্বামীকে মারধরের ভিডিওতে সাগরকেও দেখা যাচ্ছে। আমার সন্তান দুনিয়ায় আসার আগেই বাবাকে হারিয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’

কী হয়েছিল সেই রাতে 

৫ আগস্টের পর থেকে নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ। সড়কে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতিও ছিল না। যেদিন রাতে শাহাদাতকে মারধর করা হয়, সেদিনও সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, শাহাদাত হোসেনকে ১৩ আগস্ট রাত ২টা থেকে ৩টার মধ্যে মারধর করা হয়েছে। পরদিন প্রবর্তক মোড়ের অদূরে সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে বদনাশাহর মাজারের সামনের সড়কে রাস্তায় শাহাদাত হোসেনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন সেখানে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা। তারাই প্রথমে লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। পরে পুলিশ খবর পেয়ে লাশ হেফাজতে নেয়।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) মো. জাহাংগীর সমকালকে বলেন, ‘শাহাদাত হোসেনকে মারধরের ভিডিওটি দেখার পর আসামিদের শনাক্তে কাজ শুরু করে পুলিশ। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারলে হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা যাবে। এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *