বাড়ছে ভূমিকম্প প্রবণতা

সিলেট

সিলেটসহ দেশে বাড়ছে ভূমিকম্পের প্রবণতা। কখনো দেশেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, আবার কখনো প্রতিবেশী দেশে। এভাবে ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। সিলেট ও অন্যান্য অঞ্চলে বছরের প্রথম ভূমিকম্প হয় গত ৩ জানুয়ারী। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের একটি স্থানে।

এরপর গত ২৭ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত ৩টা ৬ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল নেপালের কোদারি এলাকা। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এটি মাঝারি মাপের ভূমিকম্প। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারী বুধবার মধ্যরাতে সিলেটে এবং ২৫ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূকম্পন অনুভূত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩।

আর ২৫ ফেব্রুয়ারী সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। এভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরেও ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এটি ছিল ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগের প্লেটগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। এগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর সেখানে পৌঁছানোর পর শক্তি অটুট থাকলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই ভূমিকম্প। এই প্লেটের নানা ভূগর্ভস্থ চ্যুতি আছে। সেগুলোই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের এলাকাগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। দেখা যাচ্ছে, এসব স্থানে ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪১। গত বছর তা বেড়ে হয় ৫৪।

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তের ভারত ও মিয়ানমারে ভূমিকম্পপ্রবণ। কিন্তু এখন এর প্রবণতা বৃদ্ধি কেন? ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার কারণ বোঝাতে একখ- কাঠের টুকরার উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কাঠের টুকরার দুই পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, তবে এর ভেতরে একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। একসময় উভয়মুখী চাপে কাঠটি ফেটে যেতে পারে। এক সময় টুকরাটা ভেতরে তৈরি হওয়া শক্তির চাপে ফেটে যাবে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে।

ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের মাত্রাগত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত দুই ধরনের ভূমিকম্পের কথা বলছেন তাঁরা। একধরনের ভূমিকম্প হলো রিখটার স্কেলে ৮ বা এর চেয়ে বেশি। আরেক ধরনের হলো ৭ বা এর চেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার মধ্যে সাধারণত ৮ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর ফিরে আসে। আর ৭ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে।

বাংলাদেশ বা এই ভূখন্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী এমনটি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার।

১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. রুবায়েত কবির এ বিষয়ে অতি সম্প্রতি জানান, সিলেটসহ দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল পড়েছে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে। এই অঞ্চলে যেকোনো মুহূর্তে বড় ভূমিকম্প হওয়া বিচিত্র নয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভবন নির্মাণে যেমন বিল্ডিং কোড ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন মানা হচ্ছে না, তেমনি প্রভাবশালীদের চাপে নগরায়ণ হচ্ছে স্বেচ্ছাচারীভাবে। ফলে সাময়িকভাবে কেউ কেউ লাভবান হলেও প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে সম্মিলিতভাবে কেউ রেহাই পাবে না। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি হাওর এলাকার বন্যায় সিলেটের কেন্দ্রীয় নগর এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *