বাতিল হচ্ছে ১৪টি দলের নিবন্ধনের আবেদন

রাজনীতি

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক— এমন নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিতে চলতি বছরের মে মাসে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বেঁধে দেওয়া সময়ে নিবন্ধন পেতে ইসিতে আবেদন করে ৯৩টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ১৪টি দলের আবেদনপত্র বাতিল করার সুপারিশ করেছে বাছাই কমিটি। তথ্যের ঘাটতি পূরণে বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে ৭৭টি দল। এছাড়া বাকি দুটি দল আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, প্রাথমিক বাছাইয়ে কোনো দলের আবেদনই সঠিক পাওয়া যায়নি। আইনে বলা আছে, যেসব দলের আবেদন নির্দিষ্ট ফরমেটে করা হয়নি এবং টাকা জমা দেওয়ার চালান কপি জমা দেয়নি, এমন ১৪টি দলের আবেদনপত্র বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। আর ৭৭টি দল আবেদনে বিভিন্ন রকম তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। সেসব ঘাটতি পূরণের জন্য আইন অনুযায়ী ১৫ দিন সময় দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

যেসব দলের আবেদন বাতিলের সুপারিশ
আবেদন বাতিলের জন্য বাছাই কমিটির সুপারিশ করা ১৪টি দল হচ্ছে- মুশকিল লীগ, বঙ্গবন্ধু দুস্থ ও প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ), বৈরাবরী পার্টি, বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দল, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট (বিডিএম), নতুন ধারা বাংলাদেশ-এনডিবি, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্রেটিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ), সাধারণ জনতা পার্টি (জিপিপি), জাতীয় ইসলামী মহাজোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এবং স্বদেশ কল্যাণ কর্মসূচি।

তথ্যের ঘাটতি যাদের আবেদনে
নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টি, নতুন বাংলা, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি (বিআরপি), প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (পিডিএ), বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ আম জনতা পার্টি ও বাংলাদেশ তৃণমূল জনতা পার্টি (বাংলাদেশ টিজেপি)। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, গণরাজনৈতিক জোট-গর্জো, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ হিন্দু লীগ; বাংলাদেশ জাতীয় দল, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ তৃণমূল লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএনডিপি), কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), ভাসানী অনুসারী পরিষদ, নাকফুল বাংলাদেশ, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি-বিএইচপি, বাংলাদেশ তৃণমূল কংগ্রেস, যুব স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ মাইনরিটি পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গ লীগ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি), জনতার অধিকার পার্টি (পিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), জনস্বার্থে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় ইনফাস পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ মানবতাবাদী দল, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, গণঅধিকার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি-বিপিপি, বাংলাদেশ গরিব পার্টি, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ শ্রমজীবী পার্টি, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, বাংলাদেশ জনতা পার্টি, ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (বিজেএল), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) এবং ফরওয়ার্ড পার্টি- এই ৭৭ দলের আবেদনে প্রাথমিক বাছাইয়ে তথ্যের ঘাটতি পেয়েছে নির্বাচন কমিশন গঠিত বাছাই কমিটি। এসব তথ্য-ঘাটতি পূরণের জন্য এই দলগুলোকে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।

আবেদন প্রত্যাহার করল যারা
ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা কল্যাণ পরিষদ নামের দুটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করলেও তারা আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়।

এর আগে নতুন দলের নিবন্ধনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দলগুলোর আবেদন বাছাইয়ের পর মাঠ পর্যায়ে যাদের অফিস, সমর্থক ইত্যাদি তথ্যের সঠিকতা পাওয়া যাবে সে সব দলকেই নিবন্ধন দেওয়া হবে। কোনো দলের একটি শর্তও যদি অপূর্ণ থাকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে এক শতাংশ কম থাকলেও নিবন্ধন পাবে না। যে কোনো দলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হবে।

বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৩৯টি। সম্প্রতি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল কংগ্রেসকে নিবন্ধন দিতে আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নিয়ে রায়ের কপি পেলে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

আইন অনুযায়ী, প্রতি সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নতুন দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। সে মোতাবেক নির্বাচন কমিশন এবারও বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে ৯৩টি দলের আবেদন জমা পড়ে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯০ক অনুচ্ছেদ অনুসরণে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধনের জন্য তিনটি শর্তের মধ্যে অন্তত একটি পূরণ করতে হবে। শর্তগুলো হলো-(অ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত যে কোনো সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে দলীয় নির্বাচনি প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসন লাভ; (আ) কোনো সংসদ নির্বাচনে দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ৫ শতাংশ লাভ; (ই) দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় ও অন্তত ১০০টি উপজেলায় বা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসাবে কমপক্ষে দুইশ ভোটারের তালিকাভুক্তি। তাছাড়া নিবন্ধনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলকে দলের প্যাডে নির্বাচন কমিশন বরাবর দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতাহার (যদি থাকে), বিধিমালা, দলের লোগো ও পতাকার ছবি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তালিকা, দলের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য, দলের তহবিলের উৎসের তথ্য জমা দিতে হবে।

১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল ১৪টি, যা দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৭৯) বেড়ে দাঁড়ায় ২৯টিতে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ৮১।

২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরপিওতে সংশোধনী এনে ইসিতে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিধান করে। তাতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ছিল স্বেচ্ছামূলক। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হওয়া এমন বিধানের কিছুটা প্রভাব পড়ে সেই সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে অংশ নেয় ৫৪টি দল।

২০০৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১২৬টি দল আবেদন করলে যাচাই-বাছাইয়ের পর ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি ৩৯টি দলকে নিবন্ধন দেয়। এর পরে দশম সংসদে ৪৩টি দলের আবেদন এলে আরও তিনটি দল ২০১৩ সালে নিবন্ধন পায়। সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৭৬টি দল আবেদন করলেও নিবন্ধনের যোগ্য একটিও বিবেচিত হয়নি। অবশ্য আদালতে গিয়ে ২০১৯ সালে দুটি দল আদেশ নিয়ে এলে যুক্ত হয়।

২০০৮ সাল থেকে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দলের নিবন্ধন প্রথা চালুর পর ৪৪টি দল নিবন্ধন পায়। এরমধ্যে ৫টি দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় বর্তমানে নিবন্ধিত রয়েছে ৩৯টি দল। শর্তসাপেক্ষে নিবন্ধন পেলেও স্থায়ী সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিতে না পারায় ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন আদালত অবৈধ ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালন না করায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন এবং ভোটের পরে ২০২০ সালে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি, ২০২১ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। ফলে বর্তমানে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৩৯।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *