বিএনপির ২৭ রূপরেখা : নতুন কিছু দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা

রাজনীতি

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন না করার নিয়ম চালুসহ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিএনপি। এই রূপরেখাকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছে। এখন আবার তারাই রাষ্ট্রের মেরামতের কথা বলছে। এখন দেশের সবকিছুই ভালো আছে। তাই মেরামতের কিছু নেই।

বিশিষ্টজনেরা বলছেন, বিএনপির এই রূপরেখায় নতুন তেমন কিছুই নেই। যা আছে তা শুধুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণের ফর্মুলা। তবে এই ফর্মুলা কতটুকু কার্যকর করতে পারবে দলটি তা দেখার বিষয়।

ঢাকার গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে গতকাল বিকালে আয়োজিত বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দেশবাসীর সামনে এ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এসময় যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

রূপরেখায় বিএনপি বলেছে, বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এ রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে। আর সেই জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই জাতীয় সরকার সংস্কারমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে।

বিএনপির ঘোষণা করা রাষ্ট্র সংস্কারের এই রূপরেখায় নতুন তেমন কিছু নেই জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যক্তি বিশেষ কিংবা অনেক দল অনেক কিছু বলে থাকে। দিয়ে থাকে নতুন নতুন কিছু ফর্মুলা। এখন দেখার বিষয় হলো তাদের দেয়া সেই কতটুকু তারা কতটুকু কার্যকর করতে পারে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি একটি রূপরেখা দিয়েছে- সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হয়তো ডান দলগুলো যাবে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতকে ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ।

দলগুলোকে ম্যানেজ করা আওয়ামী লীগের জন্য আগের মতো সহজ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। আগের মত এখন আর সহজ হবে না দলগুলোকে ম্যানেজ করা। তবে হ্যাঁ, চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগে অন্যদলে ভাঙনের সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে তারা দল ভারী করবে।

জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হবে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, বিএনপির সঙ্গে যাবে ডান দলগুলো আর আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দেবে বাম, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের একটা অংশ। জামায়াত ভেঙে একটা অংশ চলে যাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তুনু মজুমদার বলেন, বিএনপির ‘রেইনবো ন্যাশন’ শব্দটা শুনতে চমৎকার লাগছে। তবে তারা কি ৭৫ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা করে এটা করেছে কিনা। তাছাড়া সংবিধানের ৫ম সংশোধনী এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি ইস্যুতে তাদের বক্তব্য কি সেটা ক্লিয়ার করেছে কিনা। একই সঙ্গে তাদের ধর্মীয় এবং জাতিগত ইস্যুতে তাদের বক্তব্য কি- সে বিষয়টাও ক্লিয়ার করা উচিত।

রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিষয়টি আশঙ্কার জানিয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, বিএনপির দেয়া রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে হলে তাদের ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্তেম ছাড়তে হবে। সংবিধানে খোঁচা মেরে এটা করা যাবে না। পাকিস্তানে এমনটি করার ফলে সেখানে এর বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে।

‘রেইনবো ন্যাশন’ আইডিয়া বিএনপি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পেয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপি ‘রেইনবো ন্যাশন’ বিষয়টা পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। নেলসন ম্যান্ডেলা যখন কারাগারে ছিলেন সে সময় বিশপ ডেসমণ্ড টুটু এই ‘রেইনবো ন্যাশন’ ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, সাদাদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর হওয়া অত্যাচার ভুলে গিয়ে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলবেন।

‘বিএনপির ঘোষিত রূপরেখা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তাদের অতীত আচরণের সঙ্গে যায় কিনা তা বুঝা যাচ্ছে না’ জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের এই রূপরেখার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ পেলে বিষয়গুলো ক্লিয়ার হবে। তবে তাদের এই রূপরেখা শুনতে ভালো লেগেছে। বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়কের সরকার, যোগ করেন তিনি।

‘যারা (বিএনপি) রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে তারা কী করে দেশের মেরামত করে’ এমন প্রশ্ন রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে এখন তারাই আবার মেরামতের কথা বলে, যেটা হাস্যকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তা মেরামত করেছেন। বিএনপির আমল থেকে এখন সবকিছু ভালো আছে। দেশের মধ্যে যা মেরামত, তা আওয়ামী লীগই করছে।

‘তারা (বিএনপি) কি রাষ্ট্র সংস্কারের নামে দেশকে জিয়াউর রহমানের মার্শাল ডেমোক্রেসিতে (সামরিক গণতন্ত্র) নিয়ে যেতে চান’ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির ঘোষিত রূপরেখাকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, আসলে যাদের জন্ম অগণতান্ত্রিকভাবে, তারা যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে তখন মানুষভাবে বিএনপি আবার মার্শাল ডেমোক্রেসি ফিরিয়ে আনতে চায়।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *