বিভেদ আর বিদেশ নির্ভরতায় বিপর্যস্ত সিলেট বিএনপি

সিলেট

বিভেদ আর বিদেশ নির্ভরতায় বিপর্যস্ত সিলেট বিএনপি

প্রকাশিত : ২০২৪-০৭-১৩ ১৮:২৩:২০

নিজস্ব প্রতিবেদক

সিলেট বিভাগে বিএনপির রাজনীতি অনেকটা বিদেশনির্ভর। বিশেষ করে লন্ডনে অবস্থানরত নেতাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ। প্রায় প্রতিটি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটিতে অর্থের ছড়াছড়ি। কমিটির পদ ভাগাভাগিতে গলাগলি থাকলেও, নেতাদের বেশির ভাগই আন্দোলন প্রশ্নে জড়িয়েছেন দলাদলিতে। ফলে মহানগর, জেলা-উপজেলার তৃণমূল পর্যন্ত রয়েছে কোন্দল।

আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থতার পর এ মূল্যায়ন করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট বিভাগে একটি মহানগর ও চারটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি রয়েছে। প্রভাবশালী নেতা ও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পর এ বিভাগের নেতৃত্বে আসেন এম ইলিয়াস আলী। এক যুগের বেশি সময় তিনিও নিখোঁজ। সাইফুর রহমানের পর সিলেট বিএনপির অভিভাবক বলা হতো মোহাম্মদ আবদুল হককে (এম এ হক)। ২০২১ সালে তার মৃত্যুর পর থেকে অভিভাবকহারা বিএনপি। যদিও হাল আমলে সাবেক মেয়র ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী লাইম লাইটে এলেও তাকে কোণঠাসা করতে তৎপর আরেক অংশ। আরিফুল ছাড়াও সিলেটের তিন নেতা তাহসিনা রুশদীর লুনা (ইলিয়াস আলীর স্ত্রী), খন্দকার আবদুল মুক্তাদির এবং ড. এনামুল হক চৌধুরী চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন। এর মধ্যে মুক্তাদিরের নিয়ন্ত্রণেই জেলা বিএনপিসহ অঙ্গ সংগঠনের বেশির ভাগ কমিটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবনের নির্লিপ্ততায় আন্দোলন শেষে রদবদল প্রক্রিয়ায় জনপ্রিয় ও সক্রিয় নেতা জি কে গউসকে ওই পদে বসানো হয়েছে। সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে মিফতাহ সিদ্দিকীকে।

সুনামগঞ্জ: ২০১৯ সালের এপ্রিলে কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলনকে সভাপতি ও নুরুল ইসলাম নুরুলকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা কমিটি হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর থেকেই জেলায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কোন্দল। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইচ্ছামতো পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেছেন। উপদেষ্টা কমিটিতে যাদের রেখেছেন বেশির ভাগই প্রবাসী। জেলার রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে কমিটিতে বিএনপি ও ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ফলে ২৮ অক্টোবরের পরে আন্দোলন জেলায় কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। জেলার বেশির ভাগ নেতা নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলনে থাকার চেষ্টা করেছেন।

জেলার ধর্মপাশা, তাহেরপুর ও জামালগঞ্জে নেতাকর্মীরা দুই বলয়ে সক্রিয়। প্রয়াত এমপি নজির হোসেন ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম কামরুলের দ্বন্দ্বের জেরে অনুসারীরা পৃথকভাবে আন্দোলনে ছিলেন। দিরাই ও শাল্লায় নিষ্ক্রিয় দায়িত্বশীল নেতারা। জমে ওঠেনি আন্দোলন। সদর ও বিশ্বম্ভরপুরে নেতারা মাঠে থাকার চেষ্টা করেছেন। জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সব কমিটি লন্ডন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর চৌধুরীর দখলে। তিনি দেশে আসতে পারেন না। ফলে আন্দোলনও সংগঠিত করতে পারেননি। ছাতক ও দোয়ারাবাজারে নেতাকর্মীরা জেলা সভাপতি মিলন এবং বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর পক্ষ নিয়ে দলাদলিতে ব্যস্ত।

সিলেট জেলা ও মহানগর: ২০২২ সালে ‘অ্যারেঞ্জ’ কাউন্সিলের মাধ্যমে আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সভাপতি ও এমরান আহমদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন। এর প্রায় এক বছর পর গঠিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে নেতাকর্মীর। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে প্রবাসীদের রাখায় বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

নেতাদের অভিযোগ, জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজ নির্বাচনী এলাকার আস্থাভাজনদের কমিটিতে পদ দিয়েছেন। ফলে সিলেটে দলের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। ত্যাগীদের দূরে ঠেলে দেওয়ায় বিগত আন্দোলনে জেলা বিএনপির নেতারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। জেলা সভাপতি আন্দোলনের সময় বেশির ভাগ  ঢাকায় ছিলেন। তবে ব্যতিক্রম যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু আন্দোলনে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন।

জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনার, মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি আহসান ছাড়াও জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা মাঠে ছিলেন। তবে যুবদলের কার্যক্রম তেমন দৃশ্যমান ছিল না। আন্দোলনে দলীয় তহবিল তছরুপের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে জেলা বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে।

ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতিতে স্তিমিত বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জের রাজনীতি। যদিও ইলিয়াসপত্নী তাহসিনার রুশদীর লুনা নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছেন। দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জের নেতাকর্মীরা বর্তমান জেলা সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আহমেদের পক্ষ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। দিলদার হোসেন সেলিমের মৃত্যুর পর গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির কোনো নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে দল বিভক্ত কয়েক ধারায়। এর মধ্যে জেলা কমিটির সহসভাপতি মামুনুর রশীদ ওঠেন-বসেন বর্তমান সভাপতির কথায়। তবে শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও সাবেক সহসভাপতি আশিক উদ্দিন চৌধুরী। আন্দোলনের মাঠে নেতাকর্মী নিয়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে ত্রিধারায় বিভক্ত বিএনপি। এর মধ্যে জেলার সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম জেলা ও মহানগরের নেতাকর্মীর পাশে ছিলেন। নেতাকর্মীরা পাশে পাননি ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া জেলার সদস্য ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী এবং কেন্দ্রীয় জাসাস সভাপতি নায়ক হেলাল খানকে। তবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী মাঠে থাকার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে।

গত বছর মার্চে কাউন্সিলের মাধ্যমে নাছিম হোসেইন সভাপতি ও ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন। দেড় বছর গেলেও তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি। পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। সিলেট মহানগর নিয়ে প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যেও রয়েছে বিভক্তি। এক সময় সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর পক্ষে বিভক্ত ছিলেন নেতাকর্মীরা। এখন বিভক্তি নেতৃত্বে আছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী। আন্দোলনে মহানগর সভাপতি কিংবা মুক্তাদির তেমন ছিলেন না। সাধারণ সম্পাদক সক্রিয় ছিলেন, কারাগারেও গেছেন। আরিফুল হক চৌধুরীও আন্দোলনের মাঠে ছিলেন।

মৌলভীবাজার: ২০১৯ সালের এপ্রিলে এম নাছের রহমানকে সভাপতি ও মিজানুর রহমান মিজানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠিত হয়। দুই নেতার কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না, পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেন। জেলা বিএনপির কোনো কার্যালয় নেই। সংগঠন চলছে জোড়াতালি দিয়ে। অন্দোলনের মাঠে ছিলেন না সভাপতি। জেলার প্রতিটি থানায় রয়েছে বিভক্তি। জুড়ি ও বড়লেখায় এমপি প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ মিঠুকে প্রয়োজনেও কাছে পান না নেতাকর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, অর্থ ঢেলে কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করে চলেন তিনি।

কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে আন্দোলনের কোনো প্রভাব ছিল না। এখানকার নেতা অ্যাডভোকেট আবেদ রেজা ঢাকার কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকেন। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী শুধু ঢাকা ম্যানেজ করে রাজনীতি করেন। সদর ও রাজনগর জেলা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের আসন হওয়ায় কোন্দল চরম পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে।

হবিগঞ্জ: ২০১৯ সালের এপ্রিলে আবুল হাশিমকে আহ্বায়ক ও জি কে গউসকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটি করা হয়। আন্দোলনের সময় আহ্বায়ক বিদেশে ছিলেন। এ জন্য সাবেক এমপি শাম্মী আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানে গউসের অনুসারীরা প্রভাবশালী এবং আন্দোলনে তাদেরই সক্রিয় দেখা গেছে।

জেলায় সৌদি আরব বিএনপির সভাপতি মুকিব আহমেদ ও শাম্মী আক্তারের গ্রুপ রয়েছে এবং তারা পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেন। সাবেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জীবন শুরু থেকেই কোণঠাসা। আন্দোলনের সময়জুড়ে কারাগারে ছিলেন গউস।

নবীগঞ্জ ও বাহুবলে বিএনপির সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া লন্ডনেই বেশি থাকেন। এলাকায় সংগঠন শক্তিশালী করতে তার কোনো উদ্যোগ নেই। সাবেক ছাত্রনেতা মোখলেস লন্ডন থেকে নেতাকর্মীর পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জে বিএনপি দুই ধারায় বিভক্ত। সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জীবন ও সৌদিপ্রবাসী মুকিব আহমেদের অনুসারীরা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করেন। লাখাই ও সদরেও দুই ধারা। এর মধ্যে জি কে গউসের বাইরে এনামুল হক সেলিম রয়েছেন। তবে গউসের প্রভাবের কাছে ধরাশায়ী সেলিমের অনুসারীরা। যদিও সেলিমকে সমর্থন দিয়ে আসছেন শাম্মী আক্তার।

যুদ্ধাপরাধের মামলার পর নিষ্ক্রিয় মাধবপুর ও চুনারুঘাটের প্রবীণ নেতা ফয়সাল চৌধুরী। অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ভাই শাজাহান চৌধুরী। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি বহিষ্কার হয়েছেন। শাম্মী আক্তার ও মিজানুর রহমান চৌধুরীও এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে স্থানীয়ভাবে মিজানুরের তেমন প্রভাব নেই। জেলার দায়িত্ব নেওয়ার পর শাম্মী আক্তারও চমক দেখাতে পারেননি।

বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউস বলেন, নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন। শিগগির তিনি একটি গাইডলাইন দেবেন। তৃণমূল থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করা হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *