প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে সিলেট-৬ আসন। ভোটের মাঠের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না থাকায় আগামী নির্বাচনে বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে একসময়ের জোটসঙ্গী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এই আসনে জামায়াত তাদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তরের বর্তমান আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে। বিপরীতে মাঠে রয়েছেন বিএনপির ৯ জন মনোনয়ন প্রত্যাশি। সবাই নিজেদের মতো লবিং করে যাচ্ছেন তাদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে। ইতিমধ্যে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দুই উপজেলায় কর্মী এবং সমর্থকদের নিয়ে একাধিকবার শোডাউন করে তাদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশিরা।
এ ছাড়া ইসলামী বিভিন্ন দলও গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটিতে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশিরা হলেন- সিলেট জেলা বিএনপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. মো. এনামুল হক চৌধুরী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জেলা বিএনপি নেতা ফয়সল আহমদ চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, টাওয়ার হেমলেটের সাবেক কাউন্সিলর আ.ম. অহিদ আহমদ, সাবেক এমপি ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন লেছু মিয়ার মেয়ে ব্যবসায়ী সৈয়দা আদিবা হোসেন, বিএনপি নেতা তামিম ইয়াহইয়া, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম কমর উদ্দিনের মেয়ে ছাবিয়া খান পপি।
প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায়, কুশিয়ারা তীরবর্তী আসনটিতে আওয়ামী লীগ ছয়বার, আর দুবার করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দুই বারের বিজয়ী ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন লেচু মিয়া পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেন।
দলীয় কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। ফলে যেখানে বিএনপি নির্ভার থাকার কথা সেখানে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশি মাঠে কাজ করায় বিভক্ত নেতা-কর্মীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন বিএনপি নেতা ফয়সল আহমদ চৌধুরী।
রাতের ভোটখ্যাত ওই নির্বাচনে তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিরুদ্ধে এক লাখের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। নির্বাচন সামনে রেখে তিনি এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে তৎপরতা আরও বাড়িয়েছেন। ইতোমধ্যে বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলায় বিপুলসংখ্যক কর্মী এবং সমর্থকদের নিয়ে র্যালি ও আলোচনাসভা করার পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে অসহায় রোগীদের ফ্রী চিকিৎসাসেবা ও ঔষধ দিয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তার সমর্থনে সভা এবং সমাবেশ তার কর্মীরা। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি জনসমর্থন আদায়ে দিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি।
এর বাইরে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী শামীম ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী।
এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা অহিদ আহমদ, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম কমর উদ্দিনের মেয়ে সাবিনা খান পপি ও সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন লেচু মিয়ার মেয়ে সৈয়দা আদিবা হোসেন।
এছাড়াও মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির সহশিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক তামিম ইয়াহইয়া ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের আহ্বায়ক হেলাল খান।
এদিকে, সিলেট-৬ আসনে অতীতে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে জেলা আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানকে নির্বাচন করলেও এবার এই আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ তাদের প্রার্থী বদল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন প্রার্থী ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। তিনি এলাকায় যাতায়াত বাড়িয়েছেন। দলীয় কর্মকান্ডের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গেও মতবিনিময় করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তি ইমেজে স্বল্প সময়ে তিনি এলাকায় নিজের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করছেন জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূলের সমর্থকরা।
আসনটিতে ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা রফিকুল ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের হাফেজ মাওলানা মো. ফখরুল ইসলাম, গণ অধিকার পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী এডভোকেট জাহিদুর রহমান, খেলাফত মজলিসের মাওলানা সাদিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আজমল হোসেন নিজ নিজ দলের প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন।
জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত সিলেট-৬ আসনের প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘বিগত ১৭ বছর এই এলাকায় দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন হয়নি। দুই উপজেলার রাস্তাঘাটের অবস্থা এতোটাই করুণ যে কারণে মানুষ যাতায়াত করতে মারাত্মক দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। উন্নয়নবঞ্চিত এই দুই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে আমি মানুষের সমস্যার কথা শুনেছি এবং ইতোমধ্যে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ পরিবর্তন চায়, সে কারণে তারা আমাকে সমর্থন জানিয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে প্রত্যেক ইউনিয়নে গিয়ে মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করে যাবো। তাদেরকে উন্নয়ন উপহার দিবো।’
সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও বর্তমান জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য ব্যাবসায়ী ফয়সল আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাতের ভোটের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। তারা জনগণের রায় নিয়ে সংসদে যেতে পারে নাই সেজন্য জনগণের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। দুই উপজেলার মানুষ উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল দীর্ঘ ১৭ বছর। আমাকে যদি দল মনোনয়ন দেয় তাহলে আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাবো।’
বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামিম বলেন, ‘আমি ছাত্ররাজনীতি করে আজকের এই জায়গায় এসেছি, অনেক কঠিন সময়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দলকে সংগঠিত করতে কাজ করেছি। বয়স হয়ে গেছে তাই আমি আশা করবো শেষ সময়ে এসে দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল, সেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে শেষ পর্যন্ত দল যাকে মনোনয়ন দিবে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করবো। দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে নির্বাচন করব না।’
গণ অধিকার পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমার নেতা ভিপি নুর আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে এলাকায় কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন। আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে নারী পুরুষ সবার সাথে মিশে তাদের দু:খ কষ্ট গুলো বোঝার চেষ্টা করছি। আমি প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে সংসদে দেখতে চায়।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী হাফেজ মাওলানা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সিলেট-৬ আসনে আমাকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করার পর থেকে আমি দিন রাত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সমস্যা শুনে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে দুই উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে রাস্তা সংস্কারের জন্য আমি আমার ব্যাক্তিগত পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। মানুষ আমাকে সমর্থন করছে। আমি সবসময় মানুষের খেদমত করতে চাই। নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়ে যদি বড় পরিসরে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাই তাহলে আমি সেটা কাজে লাগাবো ইনশাআল্লাহ। নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবে, আমি যদি কোন কারণে এমপি নির্বাচিত না হয় তারপরও আমি মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকবো ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. মো. এনামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি দলের গ্রীণ সিগনাল পেয়ে মাঠে কাজ করছি। ইতোমধ্যে দুই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলেছি। দলের কর্মীরা আমাকে গ্রহণ করেছে। নির্বাচিত হলে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাস্তাঘাট মেরামতসহ পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করবো। আশা করি দল আমাকে নিরাশ করবে না।’
প্রধান সম্পাদকঃ সারওয়ার খান
সম্পাদকঃ জাকের খান (রুবেল)
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫