বিশ্বনাথে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনির আহমদের ইন্তেকালঃ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন

সিলেট

স্টাফ রিপোর্টার:

সিলেটের বিশ্বনাথের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনির আহমদ আর নেই । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া নয়টায় তিনি সিলেট শহরের নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৪ বছর। শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুর ২ টায় নিজ গ্রাম বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর গ্রামে জানাযার নামাজ শেষে  বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের এই বীর সেনানীকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নিজ পারিবারিক কবরস্হানে দাফন করা হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানাগেছে ১৯৫০ সালের ৩০ নভেম্বর বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর প্রকাশিত হাসনাজী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মো. ইদ্রিছ ও মাতার নাম ছিল মোছা. মনছুরা খাতুন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ১ম সন্তান ও একমাত্র পুত্র। ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধের দামামা বেজে যায়, তখন মাত্র ২১ বছরের তরুণ মুনির আহমদ পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও জীবনের সকল মায়া মমতা ত্যাগ করে  মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে যাওয়ার মনস্থির করেন। এরপর নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের কয়েক জনের সাথে বিশ্বনাথ থেকে বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার মুড়িয়া হাওড়ের পাড় দিয়ে বিয়ানীবাজার হয়ে লাতুবাজার অতিক্রম করে করিমগঞ্জ টাউন হলে যান। সেখানে তিনি নিজ নাম তালিকাভুক্ত করেন। পরে নর্থ ত্রিপুরা জেলার মাছিমপুরের অমরানগর থানার ইন্দিরা গার্ডেনে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ৪নং সেক্টরের অধীনে কমলপুরে এসে বালিগাঁওয়ে প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল ই-কোম্পানি ও কমান্ডার ছিলেন সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান  বাবরুল হোসেন বাবুল। তিনি কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, ধলাই টি গার্ডেন,  কাঁঠালবাড়ি, কালিঘাট টি গার্ডেনসহ প্রভৃতি স্থানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন।

মুনির আহমদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ধলাই টি গার্ডেনে যুদ্ধ করতে করতে যখন পাকি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শত্রুবাহিনীর একটি মর্টার শেলের আঘাতে তাঁর এক সহযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। আর অপর এক সহযোদ্ধা আবদুল আজিজ শহিদ হন। এ সময় পাকি হানাদার বাহিনী চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে। তখন দুজন সহযোদ্ধা কভারিং ফায়ার করে মুনির আহমদকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আনেন। এটি তাঁর কাছে যুদ্ধের একটি স্মরণীয় ঘটনা। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের রনাঙ্গনে  বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অসামান্য অবদান রাখেন।

মুনির আহমদ সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। একাত্তর সালে তিনি সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকার বিশ্বনাথ প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করতেন। এরপর পারিবারিক সহায় সম্পত্তি দেখাশুনা এবং সাংবাদিকতার পাশাপাশি আইনজীবী সহকারী হিসেবে সিলেট কোর্টে সুনামের সাথে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট জেলা আইনজীবী সহকারী সমিতি ২নং বারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।  বিশ্বনাথ সহ বৃহত্তর সিলেটে জায়গা জমির ও দলিলের জঠিল বিষয়গুলো সমাধানে বেশ সুনাম অর্জন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনির আহমদ ১৯৭৫ সালে বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের কোনারাই গ্রামের সুপরিচিত মাষ্টার বাড়ীর মোফাজ্জুল হোসেন চৌধুরীর কন্যা রাবেয়া খানমকে বিয়ে করেন। তাদের রয়েছে ২কন্যা ও ৪পুত্র। যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ১ম সন্তান মাহবূবা বি.এ সম্পন্ন করে বিশ্বনাথের দৌলতপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ২য় সন্তান মোতাহেরা খানম বি.এ সম্পন্ন করে বর্তমানে জার্মান প্রবাসী,৩য় সন্তান রওনক আহমদ বি.বি এ অনার্স সম্পন্ন করে  একজন ওয়েব ডিজাইনার ও লেখক, ৪র্থ সন্তান আমেরিকা প্রবাসী ফেরদৌস আহমদ সিলেটের একজন আইনজীবি, ৫ম সন্তান বিশ্রাম খানম ঐ.বি.এ সম্পন্ন করে এখন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও কনিষ্ঠ সন্তান মাছুমা খানম ইউনাইটেড মাস্টার্স সম্পন্ন করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

মুনির আহমদ গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন । গত ১২ ডিসেম্বর রাত সোয়া নয়টায় তিনি সিলেট শহরের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গতকাল শুক্রবার দুপুর ২ ঘঠিকায় মরহুমের

নিজ গ্রাম বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর গ্রামে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনন্দা রায়ের নেতৃত্বে পূজা প্রশাসন ও পুলিশ  বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের এই বীর সেনানীর মরদেহকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করে। এর পর বীর বীর মুমুক্তিযোদ্ধা মুনির আহমদকে নিজ গ্রামের পরিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। জানাযার দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজ আরব খান,  বীর মুক্তিযোদ্ধা সিতাব আলী, মনির উদ্দিন চৌধুরী, এস.আই জনি সহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *