খুন হওয়া শাবি ছাত্র বুলবুলের মা ইয়াসমিন বেগম নরসিংদী থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বুলবুলের মা, বড় ভাই ও বোনসহ ৯ জন রবিবার (৩১ জুলাই) সকালে ক্যাম্পাসে আসেন।
দুপুর পৌনে ২টায় ক্যাম্পাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত তারা অন্তত: একবার দেখা করতে চেয়েছিলেন খুনের সময় বুলবুলের সঙ্গে থাকা শাবি ছাত্রী মার্জিয়া উর্মির সঙ্গে। কিন্তু ‘তদন্তের স্বার্থে’ উর্মির সঙ্গে তাদেরকে দেখা করতে দেয়নি পুলিশ।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিলেটে আসা বুলবুলের বড় ভাই জাকারিয়া আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের হত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ওই মেয়ে। কিন্তু আজকে (রবিবার) মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আমি বুঝতে পারছি না- মেয়েটিকে কেনো আমাদের কাছ থেকে আড়াল করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন- সপ্তাহখানেক পরে নাকি কথা বলা যাবে। আমার ভাই হারিয়েছি। তার অন্তিম সময়ে সেই মেয়েটিই কাছে ছিল। তার কাছ থেকে দুটি কথা হলে জানতে পারতাম- কী ছিল তার শেষ কথা?’
জাকারিয়া আরও বলেন, ‘আমার ভাই আমার চেয়ে ৫ আঙ্গুল লম্বা ছিল। তার মতো ২/৩টা ছেলে তাকে মেরে ফেলতে পারে- এটা আমার বোধগম্য নয়। ওই মেয়েটি কিসের জন্য পালিয়েছে, কল-লিস্ট মুছে দিয়েছে। ছুরিকাঘাতের পর ওই স্থানে ১৫ মিনিট পর্যন্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে আমার ভাইয়ের শরীর থেকে। কিন্তু ১৫ মিনিট পরে মেয়েটি টিলার নিচে এসে মানুষ ডেকেছে। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।’
তবে ঘটনার পর প্রেস ব্রিফিং করে পুলিশ জানায়- বুলবুল হত্যাকাণ্ডে উর্মির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
গত ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় শাবি ক্যাম্পাসের গাজী-কালুর টিলার ‘নিউজিল্যান্ড’ অংশে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদকে (২২)। তার বাড়ি নরসিংদী জেলার চিনিসপুর ইউনিয়নের নন্দীপাড়া গ্রামে। বুলবুলের মা, বড় ভাই ও বোন এবং মামা কামাল আহমেদসহ ৯ সদস্যের একটি দল সাদা মাইক্রোবাসযোগে রবিবার সকাল ১০টায় প্রবেশ করেন শাবি ক্যাম্পাসে। এসময় তাদেরকে বুলবুলের আবাসিক শাহপরান হলে রিসিভ করেন এ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। হলটির বি ব্লকের ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন বুলবুল।
কিন্তু ছেলে হত্যার শোক মা সইতে পারবেন না বলে বড় ভাই জাকারিয়া নিয়ে যেতে দেননি। প্রভোস্টের কার্যালয়ে বসেছিলেন শোকে বিহ্বল পরিবার।
জাকারিয়া বলেন, বুলবুলের রুমে নিয়ে গেলে মা বেহুশ হয়ে পড়বেন। আমরাও যাইনি। আমরাও ভীষণভাবে ব্যথিত। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখানেও নিয়ে যাইনি। কারণ মা সইতে পারবে না।
বাড়ি থেকে মায়ের ছুটে আসার কারণ জানালেন জাকারিয়া। তিনি বলেন, মাকে আমরা আটকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। বুলবুল যেখানে থাকতো তিনি সেখানে আসতে চাচ্ছিলেন। তাই ক্যাম্পাসে নিয়ে আসি। আমরা দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল বুলবুল । সে খুব আদরের ছিল। আটমাস আগে বাবা মারা যান। এ অবস্থায় তাকে পড়ালেখা করাতে গিয়ে বেগ পেতে হয় আমাদের পরিবারের। কষ্ট হলেও তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পড়ালেখা করাচ্ছিলাম। আমার বোনটা ভীষণ কষ্ট করেছে বুলবুলের পড়ালেখার খরচ যোগাতে। সে বিয়ে পর্যন্ত করেনি।
এসময় বুলবুলের রুম পরিদর্শনে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ইশরাত ইবনে ইসমাইল, হল প্রভোস্ট মিজানুর রহমান, বুলবুল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দেবাশীষ দেব ও মামা কামাল আহমেদ।
একই সময়ে শাহপরাণ হল প্রভোস্ট কার্যালয়ে বসে মা ইয়াসমিন বেগম বিলাপ করছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন- ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত চাই, সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার পুত আর পাইতাম না গো। আমার পুত আমায় মা ডাকে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। আজ যদি আমার ছেলে ঝালমুড়িও বেচত তাইলি কি মারা যেত? কেউ কি খুন করতো? ভালোভাবে তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার চাই। জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
বুলবুলের শোকাহত সহপাঠীরাও এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বুলবুলের বোন সোহাগী আক্তার বলেন, যারা এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে তাদেরকে রিমান্ডে নেওয়া হোক। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই রাজমিস্ত্রি। আপনাদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদেরকে ওনাদের মতো লোকেরা খুন করে ফেলবে এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারো হাত আছে। আমাদের বিশ্বাস অবশ্যই কারো হাত আছে। ছিনতাইকারীরা এমন নির্মম ভাবে হত্যা করবে না। ছিনতাইকারী ছুরি দিয়ে একটা আঘাত করতে পারে। কিন্তু এভাবে আঘাত করবে এটা আমাদের বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়ই কারো হাত আছে। তার আঘাত দেখে মনে হয়েছে যে, তার উপর কারো ক্ষোভ ছিল। এর মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এমনও হতে পারে কেউ ওদেরক টাকা দিয়ে বলছে তোমরা কাজটি করো। তাদেরকে রিমান্ডে নেওয়া হোক। তাহলে সব সত্য বের হয়ে যাবে। আমরা আমাদের ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছেন কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, গতরাতে ভিসির সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি আজ নরসিংদী যেতেন, কিন্তু করোনার কারণে যেতে পারেননি। আমরা সিলেটে আছি শুনার পর বললেন- তিনি নাকি ঢাকায় যাচ্ছেন।
বুলবুলের মামা কামাল আহমেদ বলেন, তার মায়ের একটাই দাবি- সত্যিকারের যারা দোষী তাদের বিচার যেন হয়।
এক পর্যায়ে শাহপরাণ হল থেকে বুলবুলের পরিবারকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় প্রক্টরের সঙ্গে কথা হয় পরিবারের। এসময় ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক আমিনা পারভীন উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে বুলবুলের পরিবারের সদস্যরা পৌনে ২ টায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
এ ব্যাপারে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ইশরাত ইবনে ইসমাইলকে একাধিকবার কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
ছাত্রকল্যাণ উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক আমিনা পারভীন বলনে, বুলবুলের পরিবার চাচ্ছিলেন ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন- যে তদন্তের জন্য তার সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে না। তারা চান এই হত্যাকান্ডের যেন সুবিচার হয়। আমরা তাদেরকে আশ্বাস দিয়েছি যে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয প্রশাসন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমরা চাই এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং সুবিচার হোক।
এদিকে, বুলবুলের কক্ষে থাকা তার ব্যবহারের জিনিসপত্র পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন বলে জানালেন শাহপরাণ হলের প্রভোস্ট ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, সকালে বুলবুলের পরিবারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সে আমাদের হলের ২১৮ নং কক্ষে থাকতো। তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ , বই-খাতা, লেপ, তোষক ও বালিশসহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস পরিবারের সদস্যদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বুলবুল হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের বিচার দাবিতে ২৫ জুলাই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ পর্যন্ত ৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা সবাই আদালতে ১৬৪ ধরায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। আসামিরা হলেন- সিলেটের জালালাবাদ থানার টিলারগাঁওয়ের আনিছ আলীর ছেলে আবুল হোসেন (১৯), মো. গোলাব আহমেদের ছেলে কামরুল আহমদ(২৯) ও মৃত তছির আলীর ছেলে মো. হাসান (১৯)। পেশায় তারা সবাই রাজমিস্ত্রি ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত বছরের ডিসেম্বর স্ট্রোক করে মারা যান বুলবুলের বাবা আব্দুল ওহাব। তার মৃত্যুর পর অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে চলছিল পরিবারটি। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট বুলবুলের ইচ্ছা ছিলো- বিসিএস দিয়ে বড় কর্মকর্তা হয়ে মায়ের কষ্ট লাঘব করবে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই লাশ হতে হলো তাকে।
বুলবুল স্থানীয় শাটিরপাড়া কালিকুমার উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি ও নরসিংদী আব্দুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরে সিলেটে এসে ভর্তি হয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শেয়ার করুন