বেআইনি জমায়েত শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্যমন্ত্রী

জাতীয়

নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষের পর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার জবাব দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ নিশ্চিতে সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের দূত যে বক্তব্য রেখেছেন, তার জবাবে মন্ত্রী বলেছেন, বেআইনি জমায়েত কোনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়।

শুক্রবার রাজধানীর মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ে এসব কথা বলেন তিনি। তার অভিযোগ গণমাধ্যম পক্ষপাত দেখাচ্ছে এবং এটি খুবই অনুচিত।

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের জায়গা নিয়ে বিরোধের মধ্যে বুধবার নয়াপল্টনে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাণ যায় একজনের। গ্রেপ্তার হয় বিএনপির প্রায় পাঁচ শ নেতা-কর্মী।

পরদিন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পক্ষ থেকে আসা একটি বিবৃতি সরকারকে অসন্তুষ্ট করেছে। ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নেই বিবৃতিতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গতকাল (বুধবার) ঢাকায় নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। আমরা ঢাকায় ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার খবরে উদ্বিগ্ন। আইনের শাসনকে সম্মান জানাতে এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

পরদিন এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দেন কড়া জবাব। তিনি বলেন, ‘এই যে বড় বড় কথা বলেন, দূতাবাসের মান্যবর রাষ্ট্রদূত, বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না। আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আমাদের অতীতের অনেক বেদনা আছে; পঁচাত্তরের, একাত্তরের। তার পরও আমরা বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু এভাবে করলে বন্ধুত্বে তো ফাটল ধরবে। সবার সঙ্গে লেনদেন আমাদের আছে। অহেতুক কেন এসব কথা বলেছেন?’

তথ্যমন্ত্রী জবাবটা আসে একটু নমনীয়। তিনি বলেন, ‘সরকার শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নিশ্চিত করেছে সেই কারণেই বিএনপি সারা দেশে নয়টি বড় সমাবেশ করতে পেরেছে এবং ঢাকায়ও যাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে পারে সে জন্য সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও বিকল্প চারটি প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু পার্টি অফিসে বোমা রাখা, পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল মারা, হামলা করা, বেআইনিভাবে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করা এগুলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়।’

তিনি বলেন, ‘নয়াপল্টনে পার্টি অফিসের ভেতরে বোমা রেখে সামনের রাস্তায় সমাবেশের জন্য এতদিন গোঁ ধরে থেকে বিএনপি প্রমাণ করেছে যে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়, সন্ত্রাসী কার্যকলাপই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।’

দেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সবাই করতে পারে বলেও জানিয়ে দেন হাছান। বলেন, ‘সরকার যদি সহায়তা না করত, নিরাপত্তা বিধান না করত, তাহলে বিএনপির পক্ষে কখনও দেশের নয়টি জায়গায় বড় সমাবেশ করা সম্ভব হতো না।

‘দেশের সব কয়টি বিভাগীয় শহরে তারা সমাবেশ করেছে, সরকার তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে, সেখানে টুঁ শব্দটুকু হয়নি। যেখানে একটু হয়েছে, সেখানে তারা নিজেরা নিজেরা চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি, মারামারি করেছে।’

বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করতে দেয়া হতো জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আমাদের নেত্রীকে হত্যার অপচেষ্টাসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা ও প্রায় পাঁচ শ নেতা-কর্মীকে আহত করা হয়েছিল।

‘শেখ হেলাল এমপির জনসভায় হামলা চালিয়ে এক ডজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, কিবরিয়া সাহেব এবং আহসান উল্লাহ মাস্টারের জনসভায় হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যাসহ শতশত মানুষকে আহত করা হয়েছিল। অথচ ১৪ বছর যাবত আমরা ক্ষমতায়, তারা নির্বিঘ্নে সমাবেশ করেছে।’

তদন্ত অবশ্যই হবে

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ৭ তারিখের ঘটনা নিয়ে যে তদন্তের কথা বলেছেন, সেটি অবশ্যই হবে বলেও জানান মন্ত্রী। বলেন, ‘পুলিশ তো বিএনপি অফিসে বোমা পেয়েছে। কারা বোমা রেখেছিল, কারা বোমা বানিয়েছিল, বানানোর টাকা কারা দিয়েছিল, পুলিশের উপর কীভাবে হামলা করেছিল। এগুলো তদন্তে বেরিয়ে আসবে, পুলিশের কোনো ভুল থাকলে সেটাও তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও বিরোধ ও সহিংসতার বিষয়টিও স্মরণ করান মন্ত্রী। বলেন, ‘সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে (আমেরিকার পার্লামেন্ট এলাকা) হামলা করেছিল। সেটি যেমন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়, সেটার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে যেমন তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং করছে, মামলাও পরিচালিত হচ্ছে, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অভিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে, এখানেও ৭ তারিখের ঘটনা তার সঙ্গে তুলনীয় যে, এটাও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ।’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিএনপির প্রস্তাবেই ছিল

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের জন্য নয়াপল্টন বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করলেও বিকল্প হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কথা বিএনপিই পুলিশকে বলেছিল বলে জানান হাছান।

তিনি বলেন, ‘বিএনপির অনেক নেতারা শুরু থেকেই রাজি ছিলেন, এমনকি পুলিশের সঙ্গে প্রথম দুটো বৈঠকে বিএনপিই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারেক রহমানের নির্দেশেই তারা বিগড়ে বসে। মিরপুরে পল্লবী, কালসী মাঠ, এজতেমার ময়দান, বাণিজ্য মেলার মাঠ এমন চার-পাঁচটি বিকল্প প্রস্তাবও তারা উপেক্ষা করে।

‘তারেক রহমান দশট্রাক অস্ত্র মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, খুন, চোরাচালান, মানিলন্ডারিংয়ের আসামি এবং একজন আসামির নেতৃত্বে যখন দল পরিচালিত হয়, সেই দল অপরাধী-আসামি-সন্ত্রাসীর মতই আচরণ করবে, বিএনপিতে তাই ঘটছে।’

সরকার বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে

বিএনপি বেআইনিভাবে নয়াপল্টনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করায় সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘দেশে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বিশেষ করে পুলিশের ওপর যখন হামলা হয়, রাস্তাঘাট বন্ধ করে বেআইনিভাবে যখন সমাবেশ করা হয়, তখন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হয়েছে।

‘আমরা গত দুই সপ্তাহ ধরে বারংবার বলেছি, আপনারা যাতে বড় সমাবেশ করতে পারেন সে জন্য সরকার সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে। কিন্তু না, তারা দেশে বিশৃঙ্খলা করার জন্য নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে। এটি তো সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি।’

ফখরুল আব্বাস গ্রেপ্তার কেন

জনসভার স্থল নিয়ে যখন বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সমঝোতার ইঙ্গিত মিলছিল সে সময় গভীর রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো, সেটি নিয়েও কথা বলেন মন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস তারা সবাই ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে পাঁচ শ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, ৩ হাজার মানুষকে আগুনে দগ্ধ করা, সাড়ে তিন হাজার গাড়ি পোড়ানো, লঞ্চ-ট্রেন পোড়ানোর হুকুমদাতা হিসেবে আসামি।

‘তারা আদালতকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, হাজিরা পর্যন্ত দেয়নি। আর গত ৭ তারিখ নয়াপল্টনে যে ঘটনা ঘটলো, পুলিশের ওপর হামলা করা হলো, বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে ১৫টি তাজা বোমা পাওয়া গেল। চট্টগ্রাম ঢাকাসহ সারা দেশে যে গাড়িতে আগুন দেয়া এবং ভাঙচুর। এগুলোর হুকুম দাতাও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব ও মির্জা আব্বাস। তাদের নেতৃত্বে এগুলো হয়েছে।

‘আর তাজা বোমা নিয়ে যখন কেউ পার্টি অফিসে বসে থাকে, তখন যারা বসা ছিল সবাই তো অপরাধী, তারা তাজা বোমা নিয়ে কেন বসে ছিল? এ সব কারণে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তা করেছে।’

গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ

কিছু গণমাধ্যম নিরপেক্ষ নয় বলেও অভিযোগ করেন তথ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘গগণমাধ্যম স্বাধীন বলে একপেশে সংবাদ পরিবেশন করা গণমাধ্যমের কাজ নয়। পক্ষপাতদুষ্টতা বা রাজনীতি করা কোনো গণমাধ্যমেরই সমীচীন নয়।’ -খবর নিউজ বাংলার

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *