ব্যাংকে টাকা রাখলেই লোকসান!

জাতীয়

মূল্যস্ফীতির কাছে আমানতকারীরা অসহায় এখন। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, আবার ব্যাংকে আমানতের সুদও বেঁধে দিয়েছে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখা আমানতকারীদের কাছে এখন বড় লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিসাবি আমানতকারীরা তাই দ্বিধাগ্রস্ত ও চিন্তায়। তাঁদের প্রশ্ন, ব্যাংকে টাকা জমিয়ে তাহলে তাঁদের লাভ কী? ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে এনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (লিজিং) রাখবেন, সে উপায়ও নেই। সেখানে সুদ বেশি পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তখন মূল টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, সেই আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে মূল টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অনেক গ্রাহক মাসের পর মাস ঘুরছেন।

সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১১ অক্টোবর জানিয়েছে, আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে তা ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এ অবস্থা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। তাতে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়।

বেসরকারি ঢাকা ব্যাংকের একটি শাখার ভেতরে গত বৃহস্পতিবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (আমানতকারী) সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, সরকার একদিকে আমানতের সুদের হার কমিয়ে রেখেছে, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অন্যায্য পরিস্থিতি এর আগে কখনো ছিল বলে মনে পড়ে না।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, ব্যাংকে ১৪ ধরনের আমানত রাখার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত আসে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) থেকে। এফডিআর রাখা হয় তিন মাস থেকে তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য।

২০২০ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদের হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে হিসাবে গত আগস্টে ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার থেকে আমানতের সুদের হার বাদ দিলে যা থাকে, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত সুদের হার। সে বিবেচনায় ব্যাংকে আমানত রাখলে ৫ শতাংশ টাকা কমে যাচ্ছে আমানতকারীদের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমানতের সুদ বৃদ্ধির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে ঠিক এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

অবশ্য তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদের আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে গত বছরের আগস্টে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদের হার নির্ধারণে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি হারকে বিবেচনায় নিতেও বলা হয়েছিল তখন। এমডিদের সতর্ক করে দিয়ে আরও বলা হয়েছিল, ব্যাংকের তহবিলের প্রধান উৎস হলো আমানতকারীদের অর্থ। সুদহার কমে গেলে আমানতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

গত দুই মাসে আমানত কী পরিমাণ কমেছে সেই তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের জুনে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ২০২২ সালের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে।

একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা চান আমানতের সুদের হার বাড়ুক। সে ক্ষেত্রে ঋণের সুদও বাড়াতে হবে। যদিও এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কার্যকর কোনো দর-কষাকষি করছে না।

এ বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেনের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি শুধু বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে আছি।’

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম গতকাল বলেন, মূল্যস্ফীতির হার কমে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগের বারের মতো প্রজ্ঞাপন জারি না-ও করতে হতে পারে। কিছুটা জটিলতা আছে, আমানতের সুদ বাড়লে ঋণের সুদও বাড়তে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যে কমে গেছে, তা বাজারে গেলেই বোঝা যায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ওই একই জায়গায় আছি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ব্যাংকে আমানত রাখলে এখন লোকসান। যেটুকু সুদ দেওয়া হয়, তার ওপর আবার কর কেটে রাখা হয়।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *