ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী’র ফাঁদে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেট

জালালাবাদ রিপোর্ট : ‘ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী’র ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়েছে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সিমেবি) কর্তৃপক্ষ। ফ্যাসিবাদের দোসরদের একের পর এক ষড়যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা বাহ্যত হচ্ছে। ফলে স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত সিলেটবাসী।

সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃতদের চাকুরির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হলেও একতটি চক্র কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় দিয়ে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ উপাচার্যকে নানা মাধ্যমে হুমকি ধামকিও দিচ্ছে। ফলে স্বৈরাচারের দোসরদের ফাঁদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি, সম্পত্তি লুটপাট, গাড়ি ভাঙচুর, অর্থ লোপাট ও অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, এহেন কোনো কাজ নেই, যা করেনি আওয়ামীলীগের আমলে একবছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এত অপরাধ করেও মূল হোতারা এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অতীতে নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পদধারী নেতা হলেও ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবের পর বৈষম্য বিরোধী ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী সেজে ফাঁদ তৈরি করেছে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হকের ভাগনে আওয়ামীলীগ নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগকৃত সাবেক সহকারী কলেজ পরিদর্শক মাইদুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি চক্র। নেপথ্যে মদদ দিচ্ছে সৈয়দা জেবুন্নেছা হকের ছেলে ও বিশ^বিদ্যালয়ের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগকৃত সাবেক সহকারী পরিচালক (বাজেট) শমসের রাসেল ।

সূত্র জানিয়েছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার অংশ হিসেবে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও তৎপর রয়েছে পতিত স্বৈরাচারের লোকজন। ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী সেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ সিন্ডিকেটে অনুমোদিত বৈধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও বিষেদগার ছড়াচ্ছে তারা।

সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের দিন রাতে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হকের বলয়ের নেতা মাইদুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি, চেক বই, সম্পত্তি লুটপাট ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সূত্র জানায়, লুটপাট ও হামলায় অন্যদের মধ্যে জড়িত ছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ক্যাডার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের অনুসারী আব্দুস সামাদ চৌধুরী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ছাত্রলীগের হাফিজ গ্রুপের ক্যাডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাতিজা আশরাফুল ইসলাম হিমেল, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের আসাদ গ্রুপের ক্যাডার শফিকুল ইসলাম শফি, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সুমন গ্রুপের ক্যাডার মো. আবু মূসা, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মলয় গ্রুপের ক্যাডার রিংকু দাস, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাবেক অ্যাপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ও সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিনের ক্যাডার লোকমান আহমদ, মদনমোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক গৌতম দে, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোহাজিরুল ইসলাম রাহাত, আওয়ামীলীগের বিধান গ্রুপের ক্যাডার নূরুল আমিন চৌধুরী ও নাদিম সীমান্ত, গোলাপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা ও নাসির গ্রুপের ক্যাডার এনাম আহমদ, সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি সুজাত আলী রফিকের ক্যাডার আশরাফ আহমদ, শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তারেক আহমদ, ছাত্রলীগ ক্যাডার দুলাল আহমদ ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার কাজী মাসুদ প্রমুখ।

নগরীর চৌহাট্টাস্থ সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে লুটপাটের ঘটনায় তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট নগরের কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি জিডি করে। জিডি নং ৩৬২ (১৩/০৮/২৪)। পরবর্তীতে ১৭ আগস্ট একই থানায় আরেকটি জিডি করা হয়। জিডি নং ৫৬৪ (১৭/৮/২৪)। জিডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লুটপাটের ঘটনা উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। জিডি দুটির তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত সবাই সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুর্নীতিবাজ ভিসি অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর আমলে সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬ মাসের জন্য নিয়োগ পায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী আরো ৬ মাস তাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী একবছর পর স্বয়ংক্রিয় ভাবে তাদের চাকরি বাতিল হয়ে যায়। যদিও তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন কয়েক বছর অব্যাহত রাখে। কিন্তু ভিসি মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেতন ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়।

সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৮ এর ১২ (১০) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদনক্রমে কোনো শূন্যপদে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভাবে অনধিক ৬ (ছয়) মাসের জন্য অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক ব্যতিত অন্যান্য শিক্ষক এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও কোষাধ্যক্ষ ব্যতিত অন্য কোনো কর্মচারী নিয়োগ করিতে পারিবেন এবং প্রয়োজনে অনুরূপ নিয়োগের মেয়াদ ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করিতে পারিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয় নাই, এইরূপ কোনো পদে উক্তরূপ কোনো নিয়োগ করা যাইবে না, আরও শর্ত থাকে যে, বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে নিয়োগ নিয়মিত করা না হইলে উক্ত মেয়াদ শেষে নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে বলিয়া গণ্য হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাকরি স্থায়ীকরণ না করায় তাদের চাকরি বাতিল হয়ে যায়। ফলে তারা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ কোনো জনবল নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও তৎকালীন রেজিস্ট্রার নঈমুল হক চৌধুরীর সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ২০২২ সালে নিয়োগ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ২০২২ সালের নভেম্বরে অধ্যাপক মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর মেয়াদ শেষে চলে যান। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি নতুন ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসনে মুকুলকে নিয়োগ দেয় সরকার। তিনি যোগদানের পর সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে এক বছরের জন্য ২৭জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ১০ম সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বিলাল আহমদ চৌধুরীর সকল কাজের বৈধতা দেওয়া হয়, এতে বলা হয়, বিলাল আহমদ চৌধুরীর সকল কাজের অভিজ্ঞতা যোগ হবে। বর্তমানে এরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ জনবল বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল পাটওয়ারী জালালাবাদকে বলেন, আন্দোলনকারীদের পুরো দাবির বিষয়টি অবৈধ। তারা নানা ক্রিমিন্যাল কার্যক্রমে জড়িত। ক্রিমিন্যাল কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারণে পূববর্তী প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে জিডি করেছে। বিষয়টি তদন্ত করছে পুলিশ। তদন্ত শেষ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি অবৈধ প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, এদের অ্যাডহক নিয়োগ কয়েকবার বৃদ্ধি করেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা বিধি অনুযায়ী করা হয়নি, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে নোট দেওয়া হয়েছে। এর দায়ভার আমি কেমনে নেবো, বলেন ? উপাচার্য বলেন, ৫ আগস্টের পূর্বে আন্দোলনকারীরা আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ৫ আগস্টের পরে তারা বৈষম্য বিরোধী বনে গেছে। বৈষম্য বিরোধী দাবি করে আন্দোলনও করছে, তাদের সকল কার্যকলাপের তথ্য সকলের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল পাটওয়ারী বলেন, ইতোমধ্যে ইনভেন্টরি করা হয়েছে। অনেক নথিপত্র পাওয়া যায়নি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *