
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পেরিয়ে গেছে এক বছরের বেশি সময়। এরই মধ্যে অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতের তালিকা তৈরি করে ১৪ হাজার ৬৩৬ জনের নাম চূড়ান্তভাবে গেজেটভুক্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এখন যেন সবার একই আবদার, আর তা হলো ‘জুলাই যোদ্ধা’ হওয়া। অনেকে আন্দোলনে যুক্ত না হয়ে এবং আহত না হয়েও নিজেকে দাবি করছেন জুলাই অভ্যুত্থানের ‘আহত যোদ্ধা’ হিসেবে। ভিন্ন কারণে নিহত হলেও পরিবারের দাবি, জুলাই আন্দোলনের ‘শহীদ’! তবে ভুয়া এসব জুলাই যোদ্ধাকে ঠেকাতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। সত্যিকারের জুলাই যোদ্ধাদের শনাক্তে তদন্তে নেমেছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পুলিশের বিশেষায়িত এই দুটি ইউনিটের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, জুলাই যোদ্ধা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় সারা দেশে নতুন করে ১ হাজার ৯৩৮ জনের আবেদন জমা পড়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক দপ্তর ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরে। তবে সবার ‘আবদার’ ঠেকাতে এবং এরই মধ্যে তালিকায় নাম ওঠা ভুয়া জুলাই যোদ্ধাদের শনাক্তে এবার এসবি ও পিবিআই দিয়ে নিবিড় যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ১৪ হাজার ৬৩৬ জনের মধ্যে ৮৩৬ জন শহীদ, অতি গুরুতর আহত (ক শ্রেণি) ৬০২ জন, গুরুতর আহত (খ শ্রেণি) ১ হাজার ১১৮ জন এবং আহত (গ শ্রেণি) ১২ হাজার ৮০ জন রয়েছেন। তবে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের তালিকা নিয়ে এর আগে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। যাচাই-বাছাইয়ের দুর্বলতা নিয়েও সমালোচনা এবং প্রশ্ন উঠেছিল। এর আগেও সমালোচনার মুখে শহীদ তালিকা থেকে অনেকের নাম বাদ দিতে হয়েছে।মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পরও জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর ও বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আরও ১ হাজার ৯৩৮ জনকে নতুন করে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে গেজেট তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব আবেদন যাচাই করতে গিয়ে রাজনৈতিক আবদার, সামাজিক চাপসহ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ জন্যই এসবি ও পিবিআই দিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের পর থেকেই ‘আমিও আহত’, ‘অমুকের সঙ্গে ছিলাম’, ‘আমার নাম কেন নেই’—এমন সব দাবিতে নানামুখী চাপ সৃষ্টি হয়। শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়, সামাজিক পরিচিতি আর ভবিষ্যৎ সুবিধার প্রত্যাশাও অনেককে আবেদন করতে উৎসাহিত করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করা ১ হাজার ৯৩৮ জনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির আলোকে গত ৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনগুলো যাচাইয়ের জন্য পুলিশের বিশেষায়িত দুটি ইউনিট এসবি ও পিবিআইয়ে পাঠানো হয়। পুলিশের এই দুটি ইউনিটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠির উল্লেখ করে বলা হয়, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও জুলাই গণঅভ্যুথান অধিদপ্তর ও বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১ হাজার ৯৩৮ জনকে নতুন করে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে গেজেট তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই তালিকাটি এমআইএসভুক্ত করার আগে অধিকতর যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগওয়ারী ৪১টি জেলার ১ হাজার ৯৩৮ জনের তথ্য প্রেরণ করা হয়েছে। সংযুক্ত তালিকায় বর্ণিত ব্যক্তিগণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে আহত হয়েছেন কি না এবং তারা প্রকৃত জুলাই যোদ্ধা কি না, এ বিষয়ে পিবিআই/এসবির মাধ্যমে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোস্তফা কামাল কালবেলাকে বলেন, তারা মন্ত্রণালয় থেকে তালিকাটি পেয়ে যাচাই-বাছাই শুরু করেছেন। তবে কিছু জেলায় পিবিআইর ইউনিট না থাকায় সংশ্লিষ্ট জেলার ২৬১ জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হয়েছে।
অবশ্য এসবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসবি সারা দেশেই ১ হাজার ৯৩৮ জনের আবেদনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।গত ১৯ নভেম্বর পিবিআইর পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, জয়পুরহাট, মেহেরপুর, সুনামগঞ্জ, নড়াইল, ভোলা, ঝালকাঠি, নীলফামারী, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর ও শেরপুর—এই ১২ জেলায় পিবিআইর ইউনিট নেই। তাই এই জেলাগুলো থেকে জুলাই যোদ্ধা হওয়ার জন্য আবেদন করা ২৬১ জনের বিষয়ে তদন্ত করা সম্ভব নয়। এসব জেলার মধ্যে লক্ষ্মীপুরে ২৩ জন, খাগড়াছড়িতে ১৩ জন, জয়পুরহাটে ১৩ জন, মেহেরপুরে ২ জন, সুনামগঞ্জে ১৩০ জন, নড়াইলে ৬ জন, ভোলায় ২৮ জন, ঝালকাঠিতে ৪ জন, নীলফামারীতে ২৩ জন, লালমনিরহাটে ১২ জন, শরীয়তপুরে ২ জন ও শেরপুরে ৫ জন আবেদন করেছেন।
শেয়ার করুন


