ভোটের উৎসবে রক্তের হোলি দেখলো পশ্চিমবঙ্গবাসী। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে দিয়েই শনিবার (৮ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হলো। সহিংসতা, বোমা, গুলি, মৃত্যুর পরিসংখ্যানে আগের সব নির্বাচনকেই কার্যত ছাপিয়ে গেলো এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতায় মৃত্যু হয় ২৩ জনের। আর চলতি পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শনিবার বিকেল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। এর মধ্যে ভোটের দিনই প্রাণ হারিয়েছে ১১ জন। আহতের সংখ্যাও একাধিক।
নিহতদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, সমর্থকরা রয়েছে। তেমনি এক পঞ্চায়েত প্রার্থী ও ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারও রয়েছে।
এদিন সকাল ৭টায় শুরু হয় ভোট গ্রহণ পর্ব, চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় সহিংসতা। আসতে থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর। এর পাশাপাশি বুথ জ্যাম, জাল ভোট, ভোটারকে ভয় দেখানো, নির্দলীয় প্রার্থী ও তার সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বন্দুক উঁচিয়ে ধাওয়া করা, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়া, ব্যালট বাক্সে অগ্নিসংযোগ করাসহ রাস্তা অবরোধের একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাজ্যটির মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই জেলায় সর্বাধিক চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া কোচবিহার ও পূর্ব বর্ধমান জেলায় দুজন করে ও মালদা, নদীয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় একজন করে মৃত্যু হয়।
এছাড়া নদীয়ার শান্তিপুর ব্লকের গয়েশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোলা ডাঙ্গা ৮ ও ৯ নম্বর বুথে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূলের সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি প্রায় ২০ জন। এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনাস্থলে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ওই জেলারই চাকদা ব্লকের ঘেটুগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৫১, ২৫২, ২৫৩ নম্বর বুথে ব্যালট বাক্সে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের দিকে। প্রতিবাদে শিমুরালি-কালিবাজার রাজ্য সড়কের মন্ডলহাটে সড়ক অবরোধ করে বিজেপি।
হুগলী জেলার আরামবাগের আরাণ্ডি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সাতমাথা ২৭৩ বুথের নির্দলীয় প্রার্থী জাহানারা বেগমের এজেন্ট কায়মুদ্দিন মল্লিককে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে কোলাঘাট থানার বড়গাছিয়া ননীবালা বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় তালা মেরে ভোট বন্ধ করাসহ একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে।
ভোটের দিন সকাই মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জের শুলিতলা এলাকায় ১৬ নম্বর বুথে সানাউল শেখ নামে এক তৃণমূল কর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তার চিকিৎসা চলছে অনুপনগর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মোহনপুর পঞ্চায়েতের ১৪ নম্বরের স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিজিৎ দাসকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
মোহনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৪ নম্বর বুথে নির্দল প্রার্থী অরিজিৎ দাস এর এজেন্টরা বসেছিল। সে সময় কিছু লোক সেখানে এসে পরপর চারটি বোমা ছোড়ে। দুটি বোমা ফেটে যায় ঘটনাস্থলে। বাকি বোমা পুলিশ উদ্ধার করেছে। প্রার্থীর অভিযোগ শুধু বোমা নয়, তিন রাউন্ড গুলিয়ে চালায় দুষ্কৃতিকারীরা।
একই জেলার অশোকনগর সোলেমানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৩ নম্বর বুথের ভোটকেন্দ্রে মুড়ি মুড়কির মতো বোমাবাজি হয়। ভোটের ব্যালট বাক্স লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রিল ভেঙে। পড়ে তিনটা ব্যালট বাক্সই পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। ফলে ভোট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কের পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ বেশ কিছু তাজা বোমা উদ্ধার করে। সেখান থেকে পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
সহিংসতার মাত্রা এমন জায়গায় পৌঁছায়, যে এক প্রিসাইডিং অফিসারকে কেঁদে ফেলতে দেখা যায়। ঘটনাটি বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বরের ২ নম্বর ব্লকের ১০ নম্বর বুথের।
গোটা রাজ্যে এক দফাতেই এই পঞ্চায়েত ভোট নেওয়া হয়। রাজ্যটির ২২ জেলার মধ্যে দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় দ্বিস্তরীয় ভোট (গ্রাম সভা, পঞ্চায়েত সমিতি) ও বাকি জেলাগুলোতে ত্রিস্তরীয় (গ্রাম সভা, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ) ভোট নেওয়া হয়।
ভোট নেওয়া হয় ব্যালট পেপারে। এদিন সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে লম্বা লাইন দেখা যায়। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয় সহিংসতা। আগামী ১১ জুলাই ভোট গণনা হবে। ফলে ভোটকে কেন্দ্র করে আগামী দিনগুলোতেও যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
রাজ্যজুড়ে সহিংসতার ঘটনার প্রতিবাদে এদিন দুপুরে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনে বিক্ষোভ জানায় বিজেপি। কমিশনের অফিসের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা।
অন্যদিকে সহিংসতার ঘটনার প্রতিবাদে ‘কালীঘাট চলো’ (মুখ্যমন্ত্রী বাসভবন) ডাক দিয়েছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। তার হাতে দলীয় পতাকা থাকুক বা না থাকুক, গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে লড়াই চলবে।
এদিকে রাজ্যজুড়ে একের পর এক ভোট সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। শনিবার ভোটের দিন উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়াসহ বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখেন রাজ্যপাল।
ভোট সহিংসতা নিয়ে রাজ্যপাল বলেন, আমি আশা করি গোটা রাজ্যে যেন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ অভিযোগ জানিয়েছে প্রিসাইডিং অফিসার সহায়তা করছে না, দুর্বৃত্তরা ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে, চারিদিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের মনে মৃত্যু ভয় ঢুকেছে।
রাজ্যপাল আরও জানান, ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন হওয়া উচিত বুলেটের মাধ্যমে নয়। আমি ভোটারদের অনুরোধ করবো, তারা যেন বেরিয়ে এসে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে। আপনার একটা ভোট এই সব সমস্যার সমাধান করতে পারে।
পঞ্চায়েত নির্বাচন শান্তিতে করার দায়িত্ব যার কাঁধে, সেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা পুরো দায় নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেললেন। সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি বলেন, ফিল্ড থেকে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যা রিপোর্ট এসেছে তাতে ১২০০ থেকে ১৩০০ অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ৬০০ অভিযোগের সমাধান করতে পেরেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে তিন-চারটি জেলা থেকে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এসময় তিনি আরও বলেন, যেসব জেলায় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে, সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব এই সন্ত্রাস আটকানোর। আমার দায়িত্ব হলো ব্যবস্থাপনা করা। আমরা সব ধরনের ব্যবস্থাপনা করেছি।
এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি, বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের জোট প্রার্থীরা। তবে কিছু আসনে কড়া চ্যালেঞ্জ দিতে পারে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর প্রার্থীরা।
শেয়ার করুন