ভোটে নেই জামায়াত, আরিফে ‘রহস্য’

সিলেট

আগামী ২১ জুন সিলেটে সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। 

এ নির্বাচনে ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ অংশ নেবে না বাম দলগুলো। ঠিক একই কারণে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও সিসিকে মেয়র পদে প্রার্থী দিচ্ছে না। যদিও গত নির্বাচনে দলটি প্রার্থী দিয়েছিল। আর গত বছরের মতো এবারও এখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সিলেটে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে।

এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্তে বিএনপি সিসিক নির্বাচনে অংশ না নিলেও ব্যক্তিগতভাবে ‘রহস্য জিইয়ে’ রেখেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

অন্যদিকে, গত সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী না দিলেও এবার দলটির তিন নেতা মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে তৎপর রয়েছেন। এসব নেতার বিলবোর্ড, পোস্টার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে মহানগরের বিভিন্ন মোড়, এলাকা।

আওয়ামী লীগ:
শনিবার (১৫ এপ্রিল) দলীয় প্রার্থী নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সিসিক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুতে দীর্ঘ ২২ বছর পর সিলেটবাসী আওয়ামী লীগের মেয়র পদে পরিবর্তন দেখলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে সিলেটে করা হয়েছে নৌকার মাঝি।

দলীয় সূত্র বলছে, প্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ভাগ্য খুলেছে সিলেটে স্থানীয় শক্তিশালী প্রার্থী না থাকার কারণে। এ ছাড়া সিলেটের যাঁরা লন্ডনে বসবাস করেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকেন, তাঁদের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা থাকে। আনোয়ারুজ্জামান এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ পেয়েছেন বলেও মনে করেন দলটির অনেক নেতা।

করোনা মহামারির সময় সাবেক সিসিক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন। এবার নতুন প্রার্থী দিতেই হতো। তবে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে প্রার্থী করার বিষয়টি অনেকটা চমকই বটে। কারণ, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ভোট করার আগ্রহ দেখিয়ে কয়েক মাস ধরে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন আনোয়ারুজ্জামান। এই সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে তিনিসহ ১১ জন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্য থেকে আনোয়ারুজ্জামানকেই বেছে নেয় দলের হাইকমান্ড।

বিএনপি:
বিএনপি অনেক আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে- বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই ঘোষণার আওতায় রয়েছে সিসিকও। কিন্তু ব্যক্তিগত তৎপরতায় স্পষ্ট- আগামী সিসিক নির্বাচনে ফের প্রার্থী হতে চান বর্তমান মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু এতে বাধ সেধেছে দলীয় সিদ্ধান্ত। তাই অনেকটা বিপাকে পড়েছেন মেয়র আরিফ। না পারছেন দলীয় সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে, আর না পারছেন মেয়র প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছাকে দমন করতে। তাই তিনি ‘রহস্য জিইয়ে’ রেখেছেন।

জানা যায়, গত ২ এপ্রিল হঠাৎ লন্ডন সফরে যান আরিফ। এটি এক সপ্তাহের সফর থাকলেও দুই সপ্তাহ পর রবিবার (১৬ এপ্রিল) তিনি সিলেট ফেরেন। সেখানে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের পর লন্ডনে থাকতে তিনি বিভিন্ন বক্তব্যে মেয়র প্রার্থী না হওয়ার ইঙ্গিত দেন। তবে রবিবার দেশে ফিরে তিনি দেন ‘রহস্যজনক’ বক্তব্য। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কি না, বিষয়টি স্পষ্ট করেননি আরিফুল হক। তিনি বলেন, তাঁর একার হাতে কিছু নেই। স্থানীয় ভোটার ও সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

গণমাধ্যমকে আরিফ বলেন- দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে নির্বাচনে যাবে না। দলের এ সিদ্ধান্ত তাঁকে মানতে হবে। আবার যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, সম্মান দিয়েছেন, তাঁদেরও মূল্যায়ন করতে হবে। এমন অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, নির্বাচনে এজেন্ট ছিলেন, প্রচারণা করেছেন, আমার জন্য হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। তাঁরা নির্বাচন করতে বললে দলের কাছে আপিল করতে হবে। আর দলীয় সিদ্ধান্ত জেনে তাঁরা যদি বলেন, ইভিএম দিয়ে করা নির্বাচনের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না, সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে। আমার একার হাতে কিছু নেই।’

তাহলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে আরিফুল হক বলেন, ‘নির্বাচন করব, সেটিও বলছি না, করব না, সেটিও বলছি না। ঈদের পর এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। নির্বাচন করলে কেন করছি, সে ব্যাখ্যাও দেওয়া হবে, না করলে কেন করছি না, সে ব্যাখ্যাও থাকবে।’

আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময়েই বিএনপির মনোনয়নে টানা দ্বিতীয় দফায় সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সিলেট জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন। এ ছাড়া তিনি বিএনপির সিলেট মহানগরের সভাপতি ও জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

জাতীয় পার্টি:
আগামী সিসিক নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেতে দলটির স্থানীয় তিন নেতা দৌঁড়ঝাঁপ করছেন। তারা হলেন- মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এবং যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির সহসভাপতি আবদুস সামাদ। এ তিন প্রার্থীর সমর্থনেই সিলেটে প্রচারণা চলছে।

তবে সূত্র বলছে- সিসিকে নজরুল ইসলামের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন- ‘সিলেট জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টি সভা করে আমাকে এককভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটিও নিশ্চয়ই আমাকে মূল্যায়ন করে দলীয় মনোনয়ন দেবে বলে বিশ্বাস রাখি। যেহেতু এই সিলেট শহরেই আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি, সমাজসেবা ও ব্যবসা করছি, তাই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাই মনোনয়ন পেলে দলের পাশাপাশি আমার ব্যক্তি ইমেজও ভোটের মাঠে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

ইসলামী আন্দোলন :
গত সিসিক নির্বাচনের মতো এবারও সিলেটে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় কমিটির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসানকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের দল ইসলাম, দেশ, মানবতা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাজনীতি করে। তাই জনগণের সেবা করতেই আমরা এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।’

গত সিসিক নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন হাত পাখা মার্কায় পেয়েছিলেন ২ হাজার ১৯৫ ভোট।

জামায়াত :
গত নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী দিলেও এবারের সিটি নির্বাচনে এবার অংশ নেবে না বলে জানিয়েছেন সংগঠনের সিলেট মহানগর শাখার সেক্রেটারি শাহজাহান আলী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বর্তমান সরকারের অধীন আমরা কোনো নির্বাচনে যাবো না। এরপর কোনো স্থানীয় নির্বাচনে আমরা যোগ দিইনি। তাই এ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নও উঠে না।’

গত নির্বাচনে সিলেট মহানগর জামায়াতের তৎকালীন আমির এহসানুল মাহবুব দলের সিদ্ধান্তে স্বতন্ত্র হিসেবে মেয়র পদে নির্বাচন করে ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন।

বাসদ:
এবারের সিসিক নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে না বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-ও। দলটির সিলেট জেলা শাখার আহ্বায়ক আবু জাফর গত সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হয়ে ৯০০ ভোট পান। এবার তাঁর দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রহসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে নির্বাচন কমিশন বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া এ সরকারের অধীন আমাদের দল কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাম দলগুলোর সিটি নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সিলেটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো বাম দলই অংশ নেবে না। এ জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকাকেই তাঁরা মূল কারণ হিসেবে বলছেন।

সিপিবি সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন সুমন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার পরিবেশ ও পরিস্থিতি নেই বলে বাম জোট এবং আমাদের দল মনে করি। এ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। তাই সিটি নির্বাচনে আমরা অংশ নেব না।’

জাসদ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি লোকমান আহমদ বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোনো উৎসাহবোধ করছি না। এমনকি মানসিক তাগিদও অনুভব করছি না।’

উল্লেখ্য, আগামী ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন ইভিএমে হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৩ মে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২৫ মে। আর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ১ জুন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *