উদ্ভুত এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় আবারও যখন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করছেন তখনও বন্ধ হয়নি বিভিন্ন এনজিওর ঋণের টাকা আদায়ের কার্যক্রম। যদিও জেলা প্রসাশনের পক্ষ থেকে আগামী ৩ মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের টাকা আদায় কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কোরবাননগর ইউনিয়নের হাছনবাহার গ্রামের ২৫০ পরিবারের ২০০ পরিবারই এনজিও’র ঋণের জালে বন্দি। কিছু কিছু পরিবার তিন-চারটি এনজিও থেকে ঋণ তুলেছে। গত ১৬ জুনের ভয়াবহ বন্যায় এসব পরিবারের সবকিছু ভেসে যাবার পর তারা এখন নিঃস্ব। বেশির ভাগের খাবারেরই সংস্থান নেই। কিন্তু কিস্তির মাপ নেই। কিস্তি পরিশোধের জন্য হামিদা বেগম, নূর নেহার বেগমসহ অনেকেরই যেতে হচ্ছে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে।
গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী হামিদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করইন, বন্যার আগে যার কাম করছিলা, তার কাম শেষ অইবার আগেই (নিমাণাধীন) ঢল আইয়া ঘর ভাঙ্গিলিছে। বন্যার আগে ঘর বানাইবার লাগি গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাক থাকি ঋণ আনছিলাম, অখন কাম-কাজ নাই, ঘরের ধান-পানও নষ্ট। কিস্তির লাগি ১৬ হাজার টেকা হাওলাতি ঋণ, আর এনজিও’র কিস্তির লাগি ২০ হাজার টেকা সুদে আনছি। অখন সুদ দিতাম কিলা, আর কিস্তিঔ দিতাম কিলা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মরো আর বাঁচো, কিস্তি দিতায় অইবায়।’
মৃত আব্দুল ওয়াহাবের মেয়ে মনিরা বেগম বলেন, ‘শনিবারে আব্বা মারা গেছইন, তারারে (এনজিও আশা) গাঁওয়ের মাইনসে ফোনে জানাইছইন, আজকে (সোমবার) কিস্তির স্যারে আইয়া ফোন দিছইন, বই লইয়া গেলাম, তাইন কইন ৫ কিস্তির টেকা বকেয়া, টেকা তো দেওয়া লাগবো, আমি পরে সঞ্চয়ের টেকা থাকি কিস্তির টেকা কাটাইয়া দিয়া হিসাব শেষ কইরা আইছি।’
এ বিষয়ে নূর জাহান বেগম বলেন, ‘এনজিওর ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুককে মৃত্যু সংবাদটি জানানো হয়েছে। তাদের (মৃতের) ঘরে খাবার নেই। থাকার ঘরটাও একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও আজ তারা ওই পরিবারকে ডেকে কিস্তির তাগাদা না দিয়ে, কয়েকদিন সময় দিলে কি হতো।’
সোমবার সকালে ডিবিসির প্রতিবেদক হাছনবাহার গ্রামের বন্দেবাড়ী এলাকায় গেলে দেখতে পান, কমপক্ষে ২০ জন নারী কিস্তির টাকা ও বই হাতে নিয়ে আশার ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুককে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এসময় সংবাদ কর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়েই ওমর ফারুক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আজকে ঋণ দিতে হবে না, যারা আমাদের দেয়া সহায়তার এক হাজার টাকা পান নি তারা ছাড়া অন্যরা চলে যান। অথচ এর আগেই এই ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুক হাজেরা বেগম, রাবিয়া বেগম, বাহার বেগম, সাহানারা বেগম, রাহেলা বেগম ও মাসুদা বেগমসহ অনেকের কিস্তির টাকা নিয়ে বইয়ে হিসাব লিখে দিয়েছেন।
আশার ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, আমরা কিস্তি আদায় করছি না। ঘর মেরামতের জন্য কেউ কেউ ঋণ চেয়েছেন। তাদের দুয়েকটা কিস্তি বকেয়া আছে, সেগুলো আদায় করে নতুন ঋণ প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আমাদের ঋণ গ্রহিতাদের এক হাজার টাকা ঋণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো বিতরণের জন্য এসেছি আমরা।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায় স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ঋণ আদায় আপাতত স্থগিত রাখার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়েছে। রবিবার জেলা কৃষিঋণ কমিটির সভায় এই বিষয়ে কথা উঠেছিল। সেখানে সকল ব্যাংকের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধির সামনেই তারা সকলে বলেছেন, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবেন। এনজিও কর্মকর্তাদের সকলেই বলেছেন, তারা ঋণ আদায় করছেন না, কিন্তু আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে, দুয়েকটি এনজিও ঋণ আদায় অব্যাহত রেখেছে। পরে এনজিওগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তারা বলেছে, স্বেচ্ছায় কেউ ঋণ দিতে চাইলে নেয়া হচ্ছে, কাউকে কিস্তির জন্য চাপাচাপি করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এরপরও এই বিষয়ে কোন অভিযোগ জানা গেলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পত্র প্রেরণ করা হবে।