মুনশী ইকবাল :
নগরীতে মশার উপদ্রব মাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনায় সিলেটে সিটি কর্পোরেশনের নেই নিজস্ব কোনো জনবল। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর প্রায় ২২ বছরে এই বিভাগে নিয়োগ হয়নি কোনো কর্মী বা সুপারভাইজার।
বর্তমানে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অনিয়মিত কর্মী দিয়ে চলে মশক নিধন কার্যক্রম। অনিয়মিত ও অদক্ষ হওয়ায় তাদের দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে যা হচ্ছে তা সীমিত পরিসরে রুটিন কাজ বলা যায়। যা অপ্রতুল।
সিসিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে প্রতিটি ওয়ার্ড ভিত্তিক ইউনিট গঠন ও নিয়মিত জনবল নিয়োগ না দিলে মশক নিধনে সফলতা আসা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সিসিকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও মিলেনি সাড়া। ফলে মশার উপদ্রব থেকে সহসা মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর।
মশক নিধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যে অর্থের যোগান দরকার তা সিসিকের নেই। এজন্য স্থানীয় সরকার বরাবর বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করে সিসিক। গত বছরের ১ অক্টোবর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়- “ সিটি কর্পোরেশন এলাকা ২০২৪ সালের জুন মাসে একাধিকবার ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়। প্রাক-বর্ষা মৌসুমে বারবার আকস্মিক বন্যায় সিলেট নগরীর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। আকস্মিক বন্যার ফলে মহানগরীতে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরীকে মশার উপদ্রব হতে রক্ষার জন্য মাসব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
মহানগরীর ৪২টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মশার ঔষধ (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড), স্প্রে মেশিন, ফগার মেশিন ক্রয় করা প্রয়োজন। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে তবে তা অপ্রতুল। জনস্বার্থ বিবেচনায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধন কার্যক্রমকে আরোও জোরদার করার নিমিত্ত ১০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন।” স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর আবেদনের পর ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো সাড়া মিলেনে বলে সিসিক সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে বেশ কিছুদিন ধরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী। দিনের বেলা মশার যন্ত্রণা কিছুটা কম থাকলেও বিকেলের পর থেকে সারারাত মশার সাথে যুদ্ধ করতে হয় ঘরে বাইরে সবাইকে। দরজা-জানালা লাগিয়ে, মশা তাড়ানোর কয়েল, স্প্রে, ধোঁয়া নানান পদ্ধতি ব্যবহার করেও স্বস্তি মিলছেনা। এক্ষেত্রে তারা তাকিয়ে আছেন নগর কর্তৃপক্ষের দিকে। সিলেট নগরীতে মশক নিধন বিষয়টি দেখভাল করে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা জানায় মশক নিধনে তাদের নিজস্ব কোনো নিয়মিত জনবল নেই। ভাতাভিত্তিক অনিয়মিত কর্মী দিয়ে তাদের কাজ চালাতে হয়। বর্তমানে রোজায় সেই অনিয়মিত কর্মীরাও সবাই কাজ করতে রাজি নন। এতে সংকটের মধ্যে আরও সংকট তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মশক নিধনে যে ক্যামিকেল বা মশার ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার মাত্রা অনেক হিসেব করে দিতে হয়। মাত্রা একসাথে বেশি দিলে তা মশার উপর অ্যাটাক করবে ঠিক আছে কিন্তু এতে মানুষের স্বাস্থ্যে তা মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। তাই এই বিষয় বিবেচনা করে দুই মাসের মধ্যে ৪ বার মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এটা করা গেলে মশা উপদ্রব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন বছরে কোনোরকম মাত্র একবার অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে সিসিকের পক্ষে। বর্তমানে গত নভেম্বরে শুরু হওয়া এই অভিযান চলতি মার্চে শেষ হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুরো ৪২ টি ওয়ার্ডে প্রতিবার মশক নিধন অভিযান ২৫ লক্ষ টাকার মতো ব্যয় হয়। ফলে ৪ বার সেই অভিযান চালাতে গেলে প্রায় ১ কোটি টাকার মতো খরচ পড়ে। কিন্তু সিসিকের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেই ব্যয় বহনের সামর্থ্য নেই।
সিলেটের একটি স্বনামধন্য আইটি কোম্পানির চীফ এইচআর অফিসার এবং সিলেটের অভিজাত এলাকা শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা মুহাম্মাদ কামরুল ইসলাম জিসান বলেন, সিলেট শহরে মশার উপদ্রব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘরে-বাইরে কোথাও শান্তি নেই। শুধু উপশহর নয়, সিলেটের যেখানেই যাই না কেন, মশা আর মশা! বাসায় বসে থাকলেও মনে হয়, সারাদিন মশারি টানিয়ে বিছানার মধ্যে পড়ে থাকি। আর বাইরে বেরোলেই যেন মশারা দলবেঁধে মিছিল দিয়ে হামলা চালায়! অফিসে দরজা-জানালা বন্ধ করেও থাকা যাচ্ছে না-এসি চলার পরও মনে হয়, এসির বাতাসের সাথে ফ্রি হিসেবে মশার কামড় খাচ্ছি।
তিনি শহরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারকাজ চোখের পড়লে মশার উপদ্রব রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। উপশহরে শেষ কবে মশা নিধনের জন্য স্প্রে করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই। সত্যি বলতে বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন থেকে কেউ স্প্রে করতে আসলেও আমরা টের পাই না।
এছাড়াও, উপশহরসহ সিলেটের বিভিন্ন এলাকার ড্রেন, ডোবা, নালা দীর্ঘদিন ধরে অপরিষ্কার রয়ে গেছে। অনেকেই খোলা জায়গায় ময়লা পানি জমিয়ে রাখছেন, যা মশার বিস্তারকে আরও তীব্র করছে।আমরা বর্তমানে এমন এক সংকটে পড়েছি যে, কয়েল, স্প্রে, লিকুইড বা মশা মারার ব্যাট -কোনো কিছুতেই এই হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছি না। তিনি বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটি এলাকায় মশা নিধনের কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি, যে সমস্ত ড্রেন, নর্দমা ও জলাশয় অপরিষ্কার হয়ে আছে, সেগুলো দ্রুত পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এর জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে সিলেটের প্রতিটি এলাকায় মাইকিং করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, মসজিদে মসজিদে ইমাম-খতিবদের মাধ্যমে মুসল্লিসহ এলাকাবাসীদের সচেতন করার উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে, যেন সবাই নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট হন।’’
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধনে বর্তমানে যে কার্যক্রম চলছে তা অপ্রতুল। তাছাড়া নিয়মিত দক্ষ কর্মী না হলে তাদের দিয়ে সুফল পাওয়াও কঠিন। নিয়মিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অনিয়মিত প্রতিদিন ভাতাভিত্তিক কর্মী দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এরমধ্যে রোজায় সব কর্মী কাজ আসতে চায় না। এক্ষেত্রে নিয়মিত কর্মী পেলে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা যেতো, সুফলও আসতো।
তিনি বলেন মশক নিধনে সুফল পেতে হলে প্রতিটি ওয়ার্ডভিত্তিক আলাদা আলাদা ইউনিট করতে হবে এবং নিয়মিত লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে ধারাবাহিক অভিযান ও তদারকি সম্ভব। এ ব্যাপারে ২০২২ সালে স্বাস্থ্য বিভাগ একটি পরিকল্পনা সিসিকের পরিষদে পাঠানো হয় কিন্তু এব্যাপারে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাছাড়া গতবছরের অক্টোবরে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে যে আবদন পাঠানো হয়েছিল তারও কোনো উত্তর আসেনি বলে জানান তিনি।
শেয়ার করুন