মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বগুণ

ইসলাম ও জীবন

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইতিহাসের সেরা নেতা হিসেবে বরিত হন। নেতৃত্বের প্রতিটি ধাপে তিনি যে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেন, তা-ই তাঁকে সেরার আসনে বসায়। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের এ যুগেও তাঁর মতো সফল নেতার দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না কেউই। তাঁর আনীত ধর্মের অনুসারী হয়তো সব মানুষ হয়নি; তবে নেতৃত্বে তাঁর সাফল্যের কথা শত্রু-বন্ধু সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন। তাঁর নেতৃত্ব সুষমায় কীভাবে মোহিত হয়েছিল আরব জাতি, সেসব গল্প অকপটে বলে গেছেন পক্ষে-বিপক্ষের অসংখ্য ইতিহাসবেত্তা। মহানবী (সা.)-এর মধ্যে সফল নেতৃত্বের যেসব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলোর প্রতি খানিক আলোকপাত করব আজকের লেখায়।

রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন>>
আরবদের কোনো সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংবিধান বা সভ্যতা বিনির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল না। সাধারণত বিভিন্ন গোত্রীয় ঐতিহ্য মেনেই পরিচালিত হতো আরবের সমাজব্যবস্থা। মহানবী (সা.)-ই প্রথম তাদের শেখান—শূরাব্যবস্থা, সমতা, সেনাবাহিনী তৈরি করা, সামরিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টন, সুদৃঢ় গোয়েন্দাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কোষাগার নির্মাণ এবং তার ব্যয়পরিকল্পনা, বন্দী মুক্তির নীতিমালা, স্বরাষ্ট্র ও পরারষ্ট্রনীতিসহ একটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার সব উপাদান। এভাবেই তিনি সভ্য পৃথিবীর সামনে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ পেশ করেন।

পরিকল্পনা বাস্তবায়ন>>
একজন সফল নেতার জন্য সবার আগে এ গুণ থাকা অপরিহার্য। কারণ এর অনুপস্থিতি নেতাকে তাঁর অনুসারীদের কাছে হেয় করে তোলে। মহানবী (সা.) যে কাজের আদেশ করতেন, কিংবা যে কাজ থেকে বারণ করতেন, এর প্রথম বাস্তবায়নকারী তিনি নিজেই হতেন। যুদ্ধে তিনি সম্মুখে অবস্থান করে নেতৃত্ব দিতেন। অন্যকে উপদেশ দিয়ে তিনি নিজে কখনো যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছপা হননি। উহুদের কঠিন সংকটময় মুহূর্তে যখন নবী (সা.) মারাত্মক আহত হন, তখনো তিনি ময়দান ত্যাগ করেননি। খন্দকের যুদ্ধে যখন সাহাবায়ে কেরামকে পরিখা খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন, তিনি নিজে বসে থাকেননি; নেমে পড়েন কাজে। সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে বেশি কাজ করেন। এমনকি পেটে পাথরও বাঁধেন।

মানুষের প্রতি সদয় আচরণ>>
সফল ও আদর্শ নেতাকে অবশ্যই এ গুণে গুণান্বিত হতে হবে। মহানবী (সা.) কথায়, কাজে, আচার-আচরণে সব সময় নম্রতা-ভদ্রতা ও সহনশীলতা দেখাতেন। আল্লাহ তাআলা নিজেই সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমলতা দেখান। আপনি যদি কঠোর হৃদয় ও রূঢ় স্বভাবের হতেন, তবে আপনার সঙ্গীরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে পড়ত।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯) মহানবী (সা.) সব সময় কঠোরতার পরিবর্তে সহজতা, শাস্তির পরিবর্তে ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। এভাবেই তিনি শত্রু-মিত্র সবার হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন।

সিদ্ধান্তে অটলতা>>
মহানবী (সা.) কখনো সিদ্ধান্ত নিতে কঠোরতা করতেন না। তবে যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন, তখন সর্বোচ্চ দৃঢ়তার সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন। কেউ তাকে টলাতে পারত না। উহুদ যুদ্ধের সময় তিনি সাহাবায়ে কেরামের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে। মহানবী (সা.)-এর মত ছিল—মদিনায় থেকে যুদ্ধ করার। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবির মতামত ছিল—বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার। যখন সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, তখন তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বর্ম পরে ফেললেন। তখন সাহাবিদের অনেকেই নবীজির কাছে এসে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। ভেতরে থেকে যুদ্ধ করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন মহানবী (সা.) বললেন, ‘কোনো নবীর জন্য যুদ্ধাস্ত্র ধারণের পর তা ত্যাগ করা উচিত নয়, যতক্ষণ না শত্রুদের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়।’ (তিরমিজি)

বিরোধীদের সঙ্গে আচরণ>>
সফল নেতা কখনো সব বিরোধীর সঙ্গে এক রকম আচরণ করেন না; বরং প্রত্যেকের অবস্থা দেখে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। কখনো কারও সঙ্গে কঠোর আচরণ করতে হয়। কারও অপরাধ এড়িয়ে যেতে হয়। কারও ব্যাপারে আবার হালকা আচরণ করতে হয়। মহানবী (সা.) সব রকম কৌশলই প্রয়োগ করতেন। কাউকে তিনি উত্তম আচরণের মাধ্যমে বশীভূত করেন। কাউকে ক্ষমা করে আপন করে নেন। কাউকে আবার কঠোর শাস্তি দেন। কাউকে আর্থিক দণ্ড দেন। কাউকে নির্বাসনে পাঠান। সবার সঙ্গে কঠোরতা বা সবার সঙ্গে শিথিলতা—জনমনে নেতার ভার কমিয়ে দেয়।

যোগ্যদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ>>
সফল নেতা তাঁর অনুসারী ও সহকর্মীদের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত স্থানে বসান। মহানবী (সা.)-এর মধ্যে গুণটি পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল। তিনি প্রত্যেককে তাঁর যোগ্যতার ভিত্তিতে দায়িত্ব দিতেন এবং উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিতেন। সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তিনি বিভিন্ন উপাধি দিতেন। যেমন হজরত আবু বকর (রা.)-কে উপাধি দেন সিদ্দিক বা সেরা সত্যবাদী, হজরত আলী (রা.)-কে উপাধি দেন আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ, হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে উপাধি দেন ‘হালাল-হারামের ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞানী’, হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (সা.)-কে উপাধি দেন সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি বলে। একইভাবে হজরত আবু জর গিফারি (রা.)-কে কখনো রাজনীতিতে না জড়াতে পরামর্শ দেন। কারণ তাঁর নেতৃত্বগুণ ছিল না। (মুসলিম)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *