মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ

জাতীয়

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ আজ বায়ান্ন বছর পূর্ণ করল। বায়ান্নর বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। আজ মহান স্বাধীনতা আর জাতীয় দিবসে শপথ নেওয়া হবে সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার। আর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাষ্ট্র গঠনের। আজ বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ নয়, সারাবিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল এক দেশ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রির বীভৎস বাঙালি-নিধনযজ্ঞ চলাকালেই মধ্যরাতের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই থেকেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের হয়ে গেল। আজ সেই মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।

‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েই শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পথে আমাদের পথচলা। আজকের দিনটি তাই বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরব ও অহঙ্কারের। সবকিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার দিন। একই সঙ্গে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যেসব বাঙালি তাদের প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছেন, যেসব মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন, যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার দিন।

স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা আসে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর। রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলার পর রাত পৌনে ১টার দিকে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তার ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতা সেই ঘোষণার সেই ঘোষণা আরও অনেকেই পাঠ করেন।

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস-এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণায় বলা হয়, ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি, যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান-যতদিন না দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’

বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে মহাসড়কে। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬ শ ৮১ কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২৭৯৩ ডলার। সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সরকারি ছুটি। প্রত্যুষে রাজধানীর তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর এলাকাসহ সারাদেশে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে।

সূর্যোদয়ের ক্ষণ ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন অমর শহিদানের প্রতি। এর পর সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারাও সেখানে শ্রদ্ধা জানাবেন। এ ছাড়া বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণে ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

সকাল পৌনে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সকাল সাড়ে ৮টায় তার সরকারি বাসভবন গণভবনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করবেন তিনি। এ সময় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘মুজিবস বাংলাদেশ’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

এদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি-বেসরকারি ভবনশীর্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপকে জাতীয় ও রঙিন পতাকায় সজ্জিত করা হবে। দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, বরিশাল ও চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।

দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারসহ বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ সংখ্যা ও নিবন্ধ প্রকাশ করবে।

আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচিতে রয়েছে আজ সূর্যোদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৬টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও পৌনে ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আগামীকাল সোমবার সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় জাতীয় নেতারা বক্তব্য দেবেন।

বিএনপির কর্মসূচিতে রয়েছে আজ ভোরে সারাদেশে দলের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং আগামীকাল সোমবার দুপুর ২টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে সমাবেশ।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বঙ্গবন্ধ পরিষদ, মহিলা পরিষদ, জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলা এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, যুব, নারী, শিশু ও পেশাজীবী সংগঠন দিনব্যাপী বিস্তরিত কর্মসূচি পালন করবে।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *