মহাসড়কে বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ যান চলাচল, ৬ মাসে ১৭ জনের মৃত্যু

সিলেট

নিষিদ্ধ থাকলেও মহাসড়কে ইজিবাইক, টমটম ও অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হচ্ছে না।এ কারণে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা।চলতি বছরের ছয় মাসে কেবল সিএনজি অটোরিকশা-টমটম দুর্ঘটনায় সিলেটে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে টমটম-বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়ক দেখভালের দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করেই সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইজিবাইক, টমটম ও অটোরিকশা। এ সকল যানবাহন হাইওয়ে পুলিশের চোখের সামনে প্রকাশ্যে চলাচল করলেও তারা এ ক্ষেত্রে ‘রহস্যজনক’ নীরব ভূমিকা পালন করছে। বিনিময়ে নিয়মিত মাসোহারা আদায় হচ্ছে মর্মেও অভিযোগ রয়েছে।বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহল ক্ষুব্ধ।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মিশু এ প্রসঙ্গে বলেন, নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে সরকার ও উচ্চ আদালত পৃথক তিনটি আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু, আদেশ বাস্তবায়নের যাদের দায়িত্ব তারা নীরব। কার স্বার্থে, কেন নিরাপদ মহাসড়ক গড়তে আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। পুলিশের বিরুদ্ধে মাসোহারার অভিযোগ তো অনেক পুরনো।সিলেট-তামাবিল, ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু জাতীয় মহাসড়কে অবৈধ তিনচাকার যান চলাচল নিয়ে আমরা বার বার বলে আসছি। কিন্তু, এখনো অবৈধ তিনচাকার যান চলাচল বন্ধ হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি।

তামাবিল হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবুল কাশেম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, চুরি রোধে আইন আছে। তাই, বলে কি চুরি হয় না ? মহাসড়কে টমটম বন্ধে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। নিয়মিত অভিযান করেও পারছি না। রাতের আঁধারে মহাসড়কে টমটম নিয়ে আসে। তবে, চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানান ওসি।

জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, মহাসড়কে তিনচাকার যান বন্ধ করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দিনের বেলা আমাদের সদস্যরা সড়কে নিয়োজিত থাকেন, এ সময়ে টমটম চলাচল করে না। রাতের বেলা পুলিশের অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে টমটম চলাচল করে। সিএনজি অটোরিকশা বন্ধেও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। বৃষ্টি কমে গেলে এই অভিযান আরও জোরদার করা হবে। নিরাপদ সড়ক গড়তে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন হাইওয়ে পুলিশের এই এসপি।

জানা গেছে, তিনচাকার যানের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গেল বছরের ৪ এপ্রিল উচ্চ আদালত মহাসড়কে ব্যাটারীচালিত তিনচাকার যান উঠতে পারবেনা বলে আদেশ দেন। এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দেশের সব প্রধান মহাসড়কে তিন চাকার যান না চালানোর আদেশ দেন উচ্চ আদালত। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ও যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তার জন্যে সরকার ও উচ্চ আদালত দেশের সকল মহাসড়কে তিনচাকার সকল যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়া যাত্রীদের মধ্যে ৩১০ জনই ছিলেন বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার বাহনের চালক ও যাত্রী। এত কিছুর পরও মহাসড়কে মরণনাশক তিনচাকার যান চলাচল কোনোভাবেই বন্ধ করা যায়নি। বরং সুযোগ সন্ধানী চালকরা কখনো পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার কখনো হাইওয়ে পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে মহাসড়কে উঠে অবাধে চলাচল করে।

সিলেট-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক, সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক, সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই অবাধে চলছে এ সব তিন চাকার যান।এসকল মহাসড়কে প্রতিদিন অন্ততঃ বিশ হাজারেরও বেশি তিনচাকার যান চলাচল করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনচাকার যান থেকে স্থান ও যানবাহনভেদে হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত মাসোহারা আদায় করছে। কেবল হাইওয়ে পুলিশই নয় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশকেও নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। নিয়মিত মাসোহারার ফলে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে এসকল যান চলাচল করলেও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এর ফলে দিনকে দিন তিনচাকার যানের চালকরাও বেপরোয়া হয়ে মহাসড়কে যানবাহন চালায়। দুর্ঘটনায় কেবল তিনচাকার যাত্রী নিহত হচ্ছেন তা নয়, তিনচাকার যানের চালকেরও প্রাণহানি হচ্ছে।

বিশেষ করে সিলেট তামাবিল মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত টমটম, ইজিবাইক চলাচল করলেও এনিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। শুধু দিনেই নয় রাতের আঁধারেও এই দুর্বল ও হাল্কা যান যাত্রী নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করছে।

এদিকে, গতকাল সকালে সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান জৈন্তাপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।এ সময় স্থানীয় লোকজন মহাসড়কে অবৈধ তিনচাকার যান বন্ধ করতে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপের দাবি জানান। তারা দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিরও দাবি জানিয়েছেন।

মারা গেছেন যারা

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ইউনিয়নের শুক্রবারী বাজার নামক স্থানে দ্রুতগামী একটি ট্রাক বিপরীত দিক থেকে আসা সিএনজি চালিত অটোরিকশাটিকে (সিলেট-থ-১১-৮৮৪৯) চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই অটোরিকশার যাত্রী সজিব আহমদ নিহত হন।

১২ ফেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে সিলেট – জকিগঞ্জ সড়কের ফুলবাড়ি ইউনিয়নের হাজিপুর এওলাটিকর নামকস্থানে ট্রাক চাপায় অটোরিকশার ৪ যাত্রী জেবু বেগম (৪৫) ও তার পুত্র নুরুল ইসলাম সাজিদ (২৫), রাশেদা বেগম (৩৮) ও তার কন্যা ফারিয়া আক্তার (১৬) নিহত হন।

১৩ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ সুরমা বাইপাস সড়কের গালিমপুর রাস্তার মুখে পিকআপ ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’জন নিহত হন।

৩০ এপ্রিল রোববার সকালে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের হবিগঞ্জের বাহুবলে গাড়ি চাপায় এলাইছ মিয়া নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক নিহত হন।

গত পরশু শুক্রবার রাত ১০ টার দিকে সিলেট- তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরের দরবস্ত বাজারের অদূরে পল্লী বিদ্যুতের দপ্তরের সামনে যাত্রীবাহী বাস ও ব্যাটারি চালিত টমটমের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় মুসদ আলী (৫০), নূর উদ্দিন (৫৫), আব্দুল লতিফ (৫০), মো. কামাল (২৫), মতিন উরফে কাছাই (৪৫) নামের ৫ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে টমটম চালক আব্দুল লতিফও রয়েছেন।

জৈন্তাপুরে টমটম দুর্ঘটনা নতুন নয়

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরে টমটম দুর্ঘটনায় মৃত্যু নতুন কোনো ঘটনা নয়।গত বছরের ৭ এপ্রিল মহাসড়কের হরিপুরে যাত্রীবাহী বাস, ব্যাটারিচালিত দুটি টমটম ও মোটর সাইকেলের চতুর্মুখী সংঘর্ষে মোটরসাইকেল চালক আতাউর রহমান সানি (৩০), টমটম যাত্রী রোকন উদ্দিন (৪৫) ও শিশু তাহমিদ তাহসিন (১২) নিহত হন। ইফতারের আগ মুহূর্তের ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন অন্তত ২০ জন।

এভাবে প্রায় প্রতিদিন ওই মহাসড়কে টমটম দুর্ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, হাইওয়ে পুলিশ কিংবা স্থানীয়ভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নেয়া হয়নি সচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচিও। ফলে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।-সিলেটের ডাক

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *