এখন সমাজে পচন ধরেছে, নষ্টদের দখলে গেছে রাজনীতি, বেশিরভাগ পরিবারেই পারিবারিক শিক্ষা বলতে তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সুতরাং তার কিছু প্রভাব তো পড়বেই।
সমাজ, রাজনীতি, পরিবার সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা পাল্টে গেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সঙ্গে বদলে যায়নি কি শিক্ষক সমাজও? বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক নিয়োগে আছে ভয়াবহ রাজনীতি। সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলে নিয়োগে পেতে আর বেগ পেতে হয় না তেমন। এর যে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হওয়ার কথা তা-ই হয়েছে।
কোচিং বাণিজ্য, নকলে সাহায্য, নিজেদের মধ্যে দলাদলি থেকে শুরু করে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সরকারি দলের ছাত্রদের সঙ্গে চাঁদার টাকা ভাগাভাগি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, উপাচার্য ভবনে বিউটি পার্লার খুলে ব্যবসা, কোথায় নেই তাদের দুষ্কৃতির ছাপ? কয়েক বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটা আলাদা সম্মান ছিল। এখন নিয়মিত বিরতিতে তাদের নিয়ে ট্রল চলে।
এসব কিছুর একটা প্রভাব পড়েছে শিক্ষার মানে। দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষার মানের অকল্পনীয় অধোগতি জাতি হিসেবে ক্রমাগত আমাদের পিছিয়ে যাওয়াকেই নির্দেশ করে। যে দেশে মানসম্মত শিক্ষা দূরেই থাকুক বরং সকল পর্যায়ে এর মান কেবল কমতেই থাকে সেই দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা করবে কী করে সেটা একটি বড় প্রশ্ন। শিক্ষার সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রের পার্থক্য হলো, শিক্ষার মানের অধোগতি অনাগত বহু প্রজন্মকে সকল ক্ষেত্রে ক্রমাগত কেবল পিছিয়ে দিতে থাকবে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর মাশুল গুনতে হবে আমাদের।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডস ও ইউএস এআইডির সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম।
গবেষণাটিতে বলা হয়, ‘২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাক্ষরতা দক্ষতা ছিল আনুমানিক ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী, এটি এখন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমে আনুমানিক ২৭ দশমিক ২ শতাংশ।’ কেবল পড়তে, লিখতে এবং সংখ্যা চিনতে পারে এবং সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী এই ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। সোজা বাংলায় বলতে গেলে দেশের ৭৩ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পাস শিক্ষার্থী লিখতে, পড়তে কিংবা গুনতে জানে না। অবস্থার ভয়াবহতা বোঝাতে আর খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
দেশের শিক্ষার মান কতটা নিচে নেমেছে তার একটা চমৎকার প্রতিফলন দেখা যায় এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ‘ক’ ইউনিটের অধীনে প্রথম বর্ষের (স্নাতক সম্মান) ভর্তি পরীক্ষায় ১০.৩৯ শতাংশ (১১ হাজার ৪৬৬ জন) শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। অথচ এবার যারা এই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল তাদের শিক্ষাবর্ষে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৬২০ জন। ওদিকে ঢাবি’র ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৪ হাজার ২৮৯ জন শিক্ষার্থী)। এইচএসসি পরীক্ষায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১০ হাজার ৩৩০ জন। আর ‘ঘ’ ইউনিটে পাস নম্বরই তুলতে পারেনি ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। পাস করা মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া নয়। সেই সুযোগ পেতে আরও উচ্চ স্কোর করতে হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে জিপিএ-৫ এবং এর কাছাকাছি উচ্চ উচ্চ জিপিএ প্রাপ্তরা একটা ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পাচ্ছে না!
এদিকে ইউএনডিপি ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে’ ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ নম্বরে। জাতিসংঘ প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ নম্বরে। তিনটির মধ্যে শেষ দুটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৩’ শীর্ষক ১৪ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে কিছু দিন আগে। সেই তালিকায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের নয়টি এবং পাকিস্তানের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বসেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেলেও বাংলাদেশের নেই একটিও।
কিউএস র্যাংকিয়ে সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট অবস্থান ও স্কোর প্রকাশ করা হয়। এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয় না। আগের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ৮০১-১০০০তম স্থানে রয়েছে। ২০১২ সালে কিউএস র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১-এর মধ্যে। ২০১৪ সালে তা পিছিয়ে ৭০১তম অবস্থানের পরে চলে যায়। ২০১৯ সালে তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও পেছনের দিকে চলে যায়। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে।
এদিকে প্রতিটি জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিক্ষার মান যদি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই হয় তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য যে কেবল অবকাঠামো নির্মাণ করে লুটপাট করা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অবকাঠামো নির্মাণ হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু যদি অন্তত ন্যূনতম মানটা ধরে রাখতে না পারি তাহলে যে সবটাই জলে যায় সেটা বলার আর অপেক্ষা থাকে না।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।