‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকির সৌন্দর্যে বিভোর পর্যটকরা

মৌলভীবাজার

সাতকরার ঘ্রাণ আর চায়ের কড়া লিকার যেমন সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তেমনি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পর্যটকদের মুগ্ধ করে।

সবুজে ঘেরা এ অঞ্চলের প্রকৃতিতে উঁচু-নিচু টিলায় শীতল পাটির চা বাগান, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, রূপের রানী খ্যাত জাফলং, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুটে পড়া বিছানাকান্দি, পাথর মাড়িয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশির সাদা পাথর কিংবা উৎমা ছড়াসহ অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলোতে সারা বছর থাকে পর্যটকদের আনাগোনা।

এর বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় হাওর হাকালুকির সৌন্দর্য অবলোকনে বিভোর পর্যটকরা। ‘বর্ষায় না, আর হেমন্তে পা’ দুই মৌসুমে সৌন্দর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে হাকালুকি হাওরে।

বিশাল জলরাশির ওপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘুরে মন জুড়ায় পর্যটকদের। নৌকাযোগে হাকালুকির মাঝখানে ভাসমান সোয়াম্প ফরেস্ট হিজল করচের বাগান যেন আরেক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আর হাওর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা দর্শন অন্যতম। বিশেষ করে শিক্ষা সফরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের উপলব্দিকে বাড়িয়ে দেয়। জানার কৌতূহল জাগে। অনেকে হাওরের নির্মল বাতাস উপভোগ করতে সন্ধ্যার পর নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কিংবা সপরিবারে বিকেল বেলা ঘুরতে যান। ‘ঘুরে আসুন মিনি কক্সবাজার হাকালুকি’ শিরোনামে ২০১৫ সালে ২০ জুলাই প্রথম হাকালুকি নিয়ে বাংলানিউজের প্রতিবেদন সাড়া ফেলে। এরপর থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা হাকালুকির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে ওঠেন পর্যটকরা।

ছুটির দিনে ও ঈদে হাকালুকির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন। ৬টি উপজেলাজুড়ে বিস্মৃত হাকালুকির পশ্চিম তীরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের বাদেদেউলী গ্রামের জিরো পয়েন্ট পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের ভিড় জমে। এর ব্যতিক্রম ছিল না এবার পবিত্র ঈদুল আজহায়ও।

সিলেট শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ থাকায় শহর থেকে গাড়ি নিয়ে অনেকে সপরিবারে হাওরের নির্মল পরিবেশে সময় কাটাতে আসেন।

সোমবার (৯ জুন) বিকেলে হাকালুকি হাওরের পশ্চিম তীর ছিল লোকে লোকারণ্য। অনেকের অদেখা এই বিশাল জলরাশির ঢেউয়ে সাঁতার কাটেন। কেউ বা পানিতে নেমে বসে সময় কাটান। এ ছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের অনেকে নৌকাযোগে সপরিবারে ঘুরতে দেখা যায়। হাওর বিলাস নামে বিশাল স্টিলের তরিতে ঘুরে সময় কাটাতে দেখা যায় অনেককে। পাশাপাশি জেলেরা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন সে দৃশ্যও অবলোকন করে থাকেন এবং ফেরার সময় মিঠা পানির ছোট-বড় মাছ কিনে নিয়ে যান।

সিলেট শহর থেকে সপরিবারে হাকালুকিতে ঘুরতে আসা জাকির হোসেন বলেন, সিলেটের সবকটি পর্যটনকেন্দ্রের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। হাওর বলতে হাকালুকি অনন্য। হাকালুকির বিশাল জলরাশি, নির্মল বাতাস, সোয়াম্প ফরেস্ট, জেলেদের মাছ ধরা দেখা এবং সর্বোপরি হাওর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার দৃশ্য কেবল দেখাই নয়, অনেক কিছু শেখার আছে।

সাবেক সেনাসদস্য মঞ্জুর হোসেন বলেন, রূপ, বৈচিত্র্যে হাকালুকি ব্যতিক্রম। বিশাল হাওরের ঢেউয়ের গর্জন কক্সবাজারের সাগরের দৃশ্যকে মনে করিয়ে দেয়। আর হাওর পাড়ের নির্মল বাতাস মনকে প্রশান্তি দেয়। এখানে হাওর ঘুরতে নৌকা ভাড়াও কম, উপজেলা প্রশাসন থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া ঘণ্টায় ৬/৮শ’ টাকা। তাই ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও ঠকার কোনো সুযোগ নেই।

হাকালুকি হাওরের ‘জল দানব’ খ্যাত দোতলা বিশাল হাওর বিলাসের স্বত্বাধিকারী মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, একটি পর্যটনকেন্দ্রে নিরাপত্তা হলো মুখ্য। হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য অবলোকনে আসা পর্যটকদের এলাকার লোকজনই নিরাপত্তা দেন। যে কারণে এই পর্যটনকেন্দ্রে দিনদিন পর্যটক প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে পর্যটকদের সুবিধায় জেলা পরিষদ ঘাটলা ও শৌচাগার এবং কাপড় বদলানোর জন্য ড্রেসিংরুম নির্মাণ করে দিয়েছে। এ ছাড়া শহর থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরবর্তী হওয়ায় পর্যটকরা ঘুরে ৩ ঘণ্টার মধ্যে আবার সিলেট শহরে যেতে পারেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। তবে বর্ষাকালে হাওরের আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার হেক্টরে। ২৪০টি ছোট-বড় বিল রয়েছে হাওরে। শুধু বিলের আয়তন রয়েছে ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। শীতকালে এসব বিলে পরিযায়ী পাখির বিচরণে মুখর হয়ে ওঠে। হাওরটি সুস্বাদু ও মিঠাপানির মাছের জন্য বিখ্যাত।

ভূতাত্ত্বিকভাবে এর অবস্থান ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশে। বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৬টি উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ি ও বড়লেখা। এরমধ্যে বড়লেখায় ৩৫ শতাংশ, জুড়ি ৫ শতাংশ, কুলাউড়া ৩০ শতাংশ, ফেঞ্চুগঞ্জ ১৫ শতাংশ, গোলাপগঞ্জ ১০ এবং বিয়ানীবাজার উপজেলা হাকালুকির ৫ শতাংশ পড়েছে। তবে বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলায় হাকালুকির অংশ বেশি পড়েছে। তবে হাকালুকিতে যাতায়াতের সহজ রাস্তা ফেঞ্চুগঞ্জ অংশে।

ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরা থেকে ছোট-বড় ১০টি নদী, ৬৪টি খাল-নালা এসে নেমেছে হাকালুকির হাওরে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ৫টি নদী সোনাই, ফানাই, আন-ফানাই, কন্টিনালা ও বরোদল। এরমধ্যে বরোদল জুড়ি নদী হয়ে হাকালুকিতে মিশেছে। আর হাকালুকির পানি প্রবাহিত হয় একমাত্র জুড়ি নদী দিয়ে। এই নদীর মোহনা ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর সংলগ্ন পিঠাইটিকর এলাকায় কুশিয়ারা নদীতে মিলেছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *