মুনশী ইকবাল :
‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’। এই অমোঘ সত্যের কাছে হার মেনে আজ সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব থেকে বিদায় নিচ্ছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। নানান আলোচনা সমালোচনার পরও এই দশবছর উন্নয়ন যজ্ঞে আরিফ ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এই বিএনপির নেতার প্রতিপক্ষ দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলেও তিনি ঠিকই ক্ষমতাসীন মন্ত্রীদের ম্যানেজ করে অনেক কাজ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের তিনি ছিলেন স্নেহধন্য আর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন কাছে ‘ভাঙা মেয়র’।
সম্প্রতি মেয়র আরিফকে দেওয়া এক নাগরিক সংবর্ধনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আরিফের উন্নয়ন কাজের প্রশংসা করে বলেন আমি তাকে বলি ভাঙা মেয়র। ১৩ অক্টোবরের সেই সংবর্ধনায় মোমেন বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিলেট সফরকালে মেয়র আরিফের প্রশংসা করেন। দশবছরের পুরোটা সময় অবশ্য আরিফ কাজ করতে পারেন নি। তার মেয়াদের বড়ো একটা সময় তিনি কারগারে ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া হত্যা মামলা এবং সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হত্যা চেষ্টা মামলায় তাকে দুই দফায় ২৭ মাস কারাভোগ করতে হয়।
প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মেয়রের দায়িত্ব নেন আরিফুল হক চৌধুরী। সে বছর ১৫ জুনের নির্বাচনে তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ১০ জুন আবারও কামরানকে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন আরিফ। সর্বশেষ গত ২১ জুলাই পঞ্চম সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে এই নির্বাচনে অংশ নেননি আরিফ। আরিফ বিহীন নির্বাচনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১টি ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। আজ আনোয়ারুজ্জামানের কাছে মেয়রের দায়িত্ব ছেড়ে বিদায় নেবেন আরিফুল হক চৌধুরী।
এর আগে আরিফ ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আরিফুল হক সিসিকের ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তিনি সিলেটের প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন। সেসময় তাকে ‘ডিপ্লোম্যাটিক লিডার’ হিসেবে আখ্যা দেন সাইফুর। ওই সময় আরিফ সিটি কর্পোরেশনের ‘নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
সেসময়ও তিনি কাজের মাধ্যমে সবার মন জয় করে নেন।
বিপুল ভোটে আওয়ামীলীগের তুমুল জনপ্রিয় প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে আরিফুল হক মেয়র নির্বাচিত হয়ে নগর উন্নয়নে তার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। রাতদিন যখন তখন বেরিয়ে যান তার লোকবল নিয়ে। অভিযানে পর অভিযান চালিয়ে ফুটপাত দখলমুক্তকরণ, রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে দ্রুত নগরবাসীর কাছে তার জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এই গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে আরিফ প্রথম মেয়াদেই হাত দেন অবৈধভাবে দখলকৃত ছড়া উদ্ধার, রাস্তা প্রশস্তকরণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে। উদ্ধার করা ছড়ায় স্পিডবোড চালিয়ে আলোচনায় আসেন মেয়র। নগরবাসী তার এসব কাজকে স্বাগত জানান। তারা নিজেদের হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যবান জায়গা ছেড়ে দেন। রাস্তা ও ড্রেন বড়ো প্রশস্ত হওয়ায় এর সুফল মিলে তখন। ফুটপাতগুলো উদ্ধার করে লাল টাইলস দিয়ে সাজিয়ে করা হয় হাঁটার উপযোগী। বিভিন্ন ছড়া ও খালের তীরে গড়ে তুলেন দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে।
যার সূত্রপাত হয় নগরীর পাঠানটুলা গোয়াবাড়ি ওয়াকওয়ের মাধ্যমে। সবুজ চা বাগানের বুক চিরে খালের উপর দিয়ে করা হাঁটার এই রাস্তা সুন্দরের পাশাপাশি তৈরি হয় দর্শনীয় স্থানে। এভাবে একসময়ের বাজে আড্ডা ও দখলের জায়গাগুলো নগরবাসীর চিত্ত বিনোদনের স্থানে রূপ নেয়। শাহজালাল রা. দরগা এলাকা তারবিহীন করে নগর সজ্জায় মেয়র নিয়ে আসেন নতুন মাত্রা। যা গোটা দেশেরই দৃষ্টি কাড়েন। রাস্তাঘাট সুন্দর করে তা এতটাই দৃষ্টিনন্দন করা হয় যে অনেকে সিলেটকে মিনি লন্ডন বা দ্বিতীয় লন্ডন বলে অভিহিত করতে থাকেন। এসব উন্নয়ন কর্মকান্ড করতে গিয়ে মেয়রকে অনেকসময় সমালোচনার মুখোমুখিও পড়তে হয়েছে। কখনও তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছে।
এক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি সমালোচনা মুখে পড়ে নগররীর প্রচীনতম কবরস্থান নয়সড়কের মানিকপীর টিলার সংস্কার কাজ করতে গিয়ে। রাতের আঁধারে টিলা খুঁড়ে লাশের হাড়ের ঝনঝনানি মানুষের আবেগে ক্ষত সৃষ্টি করে। একসময়ের রাতের বেলার ভূতুড়ে মানিকপীর এখন পার্কের মতো ঝকঝকে হয়েছে ঠিক তবে মানুষের মনে আরিফের সেই ক্ষত রয়ে গেছে। এখনও সেই কথা মনে করতে গিয়ে অনেকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। কত প্রিয়জনের কবরে উপর দিয়ে চলে গেছে পায়ে হাঁটা রাস্তা।
হকার উচ্ছেদ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে গিয়ে আরিফ নগরবাসীর ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান। হকারদের উচ্ছেদের পর পুনর্বাসনে লালদীঘির হকার মার্কেটে বিশাল জায়গা তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু গুটিকয়েক হকার সেখানে অবস্থান নিয়ে বাকিরা রাস্তা আর ফুটপাত দখল করেই বসে আছে। প্রায়ই হকারদের সাথে সিসিক বাহিনীর চোরপুলিশ খেলা দেখা যায়। অভিযোগ আছে অসাধু ব্যক্তিদের দৈনিক অবৈধ চাঁদার ভিত্তিতে ম্যানেজ হকাররা রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন। হকার মুক্ত সিলেট গড়তে মেয়র আরিফের নানান উদ্যোগ থাকলেও দৃশ্যত তা ব্যর্থই বলা যায়। এজন্য অবশ্য প্রায় সময়ই আরিফের পক্ষ থেকে প্রশাসন ও পুলিশের অসহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে।
পূর্ববর্তী মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের সময় নগরভবন গণমাধ্যম বান্ধব থাকলেও আরিফের সময় তা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যায় বলে গণমাধ্যম কর্মীদের অভিযোগ অনেকদিনের। মেয়রকে ফোনে পাওয়া ছিল যেন আলাদিনের চেরাগের মতো। তার নির্দিষ্ট কিছু খলিফা সংবাদকর্মী ছাড়া তিনি কারে ফোন ধরতেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কোনো সংবাদের জন্য তার বক্তব্যের প্রয়োজন হলে সেই খলিফাদের সহায়তায় কথা বলতে হতো। এই দশবছরে সাংবাদিকদের মধ্যে আরিফ সিন্ডিকেট বলে একটা কথাও প্রচলিত হয়ে যায়।
এই সিন্ডিকেটই আরিফকে বেষ্টন করে রাখতো। এ নিয়ে প্রায়ই তুমুল সমালোচনা হলেও আরিফ মেয়াদের শেষপর্যন্তও তা পাত্তা দেননি। সিসিক সম্পর্কিত কোনো সংবাদ করতে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নিতে শেষ মেয়াদে তাই সংবাদকর্মীদের প্রধান প্রকৌশলীর বক্তব্যের উপর নির্ভর করতে হতো। তবে শেষদিকে এসে প্রধান প্রকৌশলীও গণমাধ্যম এড়িয়ে চলা শুরু করেন। প্রায়ই তিনি ফোন ধরেন না এবং পরে ব্যাকও করেন না। সাবেক মেয়র মরহুম বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের কথা উল্লেখ করে অনেকেই প্রায় সময় বলেন কামরান ফোন ধরতে না পারলে রাত তিনটাও ব্যাক করতেন কিন্তু আরিফ তার ব্যতিক্রম। আরিফের এই আচরণ তার ভালো অধ্যায়ে একটি কালো দাগ হিসেবে আখ্যায়িত।
নানান উন্নয়ন কর্মকান্ড, সামাজিক যোগাযোগ, সাংগঠনিক ম্যানেজম্যান্ট মিলিয়ে আরিফ সব সময়ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক আলোচনায় ছিলেন। তবে মেয়াদের শেষদিকে এসে ২০২২ ও ২০২৩ সালে বৃষ্টিতে বাসাবাড়িতে পানিবন্দী অবস্থা, চতুর্দিকে খুড়াখুড়ি নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। একই রাস্তা ও ড্রেন বারবার ভেঙে আবার নির্মানে সরকারি অর্থের ব্যাপক অপচয় হিসেবে দেখেন নগরবাসী।
এতে বিভিন্ন রাস্তায় দীর্ঘ সময় লেগে থাকে কৃত্রিম যানজট, বাড়ে দুর্ভোগ। এরবাইরে সিসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সারাবছরই সমালোচিত ছিল। মাঝেমধ্যে মেয়র অভিযানে বের হলে রাস্তাঘাট ও নালানর্দমা ভালোকরে পরিষ্কার করা হয়। নইলে সকাল গড়িয়ে দুপুরে নগরীর ব্যস্ততম রাস্তা আবর্জনার স্তুপ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে সবকিছু মিলিয়ে সিলেট নগরীতে আরিফুল হক চৌধুরী একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে আসেন। যার ফলস্রুতিতে সিলেট সুন্দর শহর হিসেবে নাম কুড়ায়।