যেভাবে হত্যা করা হয় আবরারকে

জাতীয়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্বদ্যালয়ের (বুয়েট) হলে ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

আজ বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করেন।

যেভাবে হত্যা করা হয় আবরাকে
কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বিকেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিজ ক্যাম্পাসে ফেরেন মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। ওই দিন বিকেলের দিকে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন।

বাড়ি থেকে ফিরে আবরার নিজের কক্ষেই পড়ালেখা করছিলেন। ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকতেন ছাত্রলীগের ৪ নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করেন তারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। এক পর্যায়ে আবরারকে তার ফেসবুক আইডি ওপেন করতে বলেন। পরে তারা তার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে তাকে ছাত্র শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন।

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদের সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন আবরারকে মারধর শুরু করেন। তাকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’- এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরও ৭ থেকে ৮ জন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্মম মারধরের এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আবরারের দেহ। রাত দুইটার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়। নির্যাতনের সময় আবরারের চিৎকার আশপাশের অনেকে শুনতে পেলেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। পরে সিঁড়িতে মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে তারা বুঝতে পারেন আবরারকে হত্যা করা হয়েছে।

ওই ঘটনার পর কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন পেটাতে পেটাতে আবরারকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। আবরার তাতে রাজিও হন। তারপরও তাকে ছাড়া হয়নি, নৃশংস ও নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

হলের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা ওই সময় দাবি করেছিলেন, প্রতি রাতেই শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কমবেশি হই-হুল্লোড় করেন। কিন্তু সেদিন রাতে তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। বিষয়টি গভীর রাতে জানতে পারেন তিনি।

আবরারকে হত্যার ঘটনা জানাজানির পর হলজুড়েই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ওই ছাত্রের রুমমেট ও সহপাঠীরাও এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবরারের কয়েকজন সহপাঠী জানিয়েছিলেন হত্যার পর দীর্ঘক্ষণ আবরারের লাশটি ২০১১ নম্বর কক্ষেই পড়ে ছিল। রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তার নিথর দেহ নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে নিচতলা ও দোতলার মাঝখানের সিঁড়িতে তার লাশটি ফেলে রাখা হয়।

মারধরে আবরারের দেহ নিস্তেজ হওয়ার বিষয়টি জানাজানির পর হলটিতে থাকা শিক্ষার্থীরা হলের চিকিৎসকদের খবর দেন। চিকিৎসক এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ওই সময়ে হলের প্রভোস্টও ঘটনাস্থলে আসেন। বুয়েটের চিকিৎসক মাশরুক এলাহী সে সময় জানান, খবর পেয়ে তিনি রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারেন- ছেলেটি বেঁচে নেই।

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে। দুই দিন আগে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু চুক্তির সমালোচনা করে কেনো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছ- এমন কৈফিয়ত চায় সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগের নেতারা। উত্তর দেওয়ার আগেই শুরু হয় বেধড়ক পিটুনি। নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে বমি করে ফেলেন মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার। প্রস্রাবও করে ফেলেন। পরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে আবারও মারধর করা হয় তাকে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে মন নরম হয়নি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলে মরদেহ হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখেন তারা।

সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গিয়েছিল
হত্যার পর আবরারকে সিঁড়িতে ফেলে রাখার একটি ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, আবরারকে মারধরের পর কক্ষ থেকে বের করা হচ্ছে। প্রথমে একজন বারান্দা দিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান। এরপর তিনি একই পথে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আরও ৩ জনকে দেখা যায় যারা আবরারকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে। ওই ৩ জনের পেছনে আরও একজনকে হাঁটতে দেখা যায়। এরপরই চশমা পরা একজন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বেরিয়ে আসেন। এর পরপরই আরও পাঁচজনকে ওই বারান্দা দিয়ে পেছনে হাঁটতে দেখা যায়। তাদের একজন আবার মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন।

নির্মম নির্যাতনে আরও যারা অংশ নিয়েছিল
আবরারের ওপর নির্যাতন চলার সময় ওই কক্ষে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ছাড়াও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ সকাল, উপ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, ক্রীড়া সম্পাদক নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মিফতাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অনিক সরকার, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বী তানিম ও মুজাহিদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই অবরারকে নির্যাতনে অংশ নেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *