রমজানেও বিদ্যুৎ ঘাটতির শঙ্কা

সিলেট

চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর হলেও ক্যালেন্ডারের হিসাবে আগামী ২৩ মার্চ থেকে শুরু পবিত্র রমজান মাস। হাতে সময় মাত্র ১ মাস। অথচ রমজান মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে কোনো সুখবর নেই। মুসলমানদের ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ এ মাসে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা ক্রমশ ঘনীভুত হচ্ছে। লোডশেডিং ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ হওয়ায় রমজানে বিদ্যুৎ বিড়ম্বনায় পড়তে হবে সিলেটবাসীকে।

যদিও রমজানে সিলেটবাসীকে ইফতার সেহরীর সময়সহ রাতের বেলায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের আশ^াস দিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগীয় অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ। তবে এ বিষয়টি জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের উপরই নির্ভর করবে বলে জানান তারা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সিলেট বিভাগীয় অফিসের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বিদ্যুতের চলমান সঙ্কট মূলত জাতীয়। স্থানীয়ভাবে আমাদের কোন সমস্যা নেই। আসন্ন রমজান মাসে সিলেট বিভাগে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা সর্বনিম্ন ৬৭০ মেগাওয়াটের মতো দাঁড়াবে। জাতীয়ভাবে নতুন কোন সমস্যা না হলে রামপাল, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল থাকলে এবং জাতীয় গ্রীডে ভারত থেকে আমদানী করা আদানীর বিদ্যুৎ যোগ হলে রমজানে সিলেটে বিদ্যুৎ নিয়ে তেমন সঙ্কট হবেনা।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিলেট বিভাগে ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এরমধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে এভাবে চলছে। ফলে কিছু জায়গায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। রমজানে আমরা জরুরী সেবাখাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস ও কয়লার অভাবে কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। লোডশেডিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট চলছে, সিলেটে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও রাজধানীর বেশির ভাগ গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। আবার কয়লার অভাবে পড়তে যাচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনও বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

জানা গেছে, উৎপাদন সক্ষমতা উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা সম্ভব হবে না। ফলে বহু সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হয়ে যেতে পারে। এদিকে জ্বালানি সংকটে গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। কোনো কোনো এলাকায় দিনে ২ থেকে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়। জ্বালানি সংকটে এবার শীতেও কমবেশি লোডশেডিং করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মার্চ থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারীতে দুই দফায় ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দাম দিয়েও বিদ্যুতের ভোগান্তি থেকে মুক্তির আশ্বাস মিলছে না। আগামী মাসগুলোতে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকে আভাস দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে শীত শেষে হালকা গরম পড়ছে। চলছে সেচ মৌসুম। মার্চে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে রমজান মাস। ফলে আগামী দিনগুলোতে আবহাওয়ার উত্তাপের সঙ্গে সেচ ও রমজানের বাড়তি চাহিদা মেটাতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। আগামী এপ্রিল-মে মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। প্রকৃত চাহিদা এর চেয়েও বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

জানা গেছে, সংকট মোকাবিলায় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়েছে। বাড়তি জ্বালানি তেল আমদানির পরিকল্পনাও চূড়ান্ত। গ্রীষ্মে সরকারের বড় ভরসা কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা, রামপাল এবং ভারতে আদানির গড্ডা। এসব কেন্দ্রে কয়লার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অর্থের অভাবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এলসি জটিলতায় চাহিদা অনুসারে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছেন না বেসরকারি উদ্যোক্তারা। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকেও (বিপিসি) ভুগতে হচ্ছে এলসি জটিলতায়। ডলার সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি কার্যক্রমও। আমদানি ব্যয় মেটাতে ও বিল পরিশোধে আগামী মে পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৬০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকার এই ডলার জোগান দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, এবার গরমে অন্তত ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকতে পারে পিক আওয়ারে। ফলে লোডশেডিং পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২৪ হাজার ১১৪ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন গত বছরের ১৭ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটে সক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি কখনোই। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও কেন্দ্র মালিকদের চুক্তি অনুসারে ঠিকই টাকা দিতে হয় সরকারকে। ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) হিসেবে গত ১২ বছরে বেসরকারি মালিকদের ১ লাখ কোটি টাকার ওপর অর্থ পরিশোধ করেছে সরকার। সামনে আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হচ্ছে। ফলে এই খরচ আরও বাড়বে।

পিডিবির তথ্য থেকে জানা গেছে, গেল সপ্তাহের শনিবার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০ হাজার ৫৮৬ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৫৮৬ মেগাওয়াট। পিডিবির মতে, দেশে কোনো লোডশেডিং ছিল না। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। গত শনিবার গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট। এদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ৮৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আগামী এপ্রিল-মে মাসে পিডিবি গ্যাস থেকে ৬ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। এ জন্য দিনে কমপক্ষে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দরকার। পেট্রোবাংলা বলছে, বিদ্যুতে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকতে পারে।

আগামী জুন পর্যন্ত ১৬১ কোটি ডলারে ৩৬ কার্গো এলএনজি আনতে চায় পেট্রোবাংলা। অর্থ সংকটে এলএনজি টার্মিনাল ও এলএনজি আমদানির বিল বকেয়া পড়েছে বলে জানা গেছে। বঙ্গোপসাগরে স্থাপিত এলএনজি টার্মিনাল দুটির পেছনে মাসে পেট্রোবাংলার খরচ দেড় লাখ ডলার। দেশে কর্মরত বহুজাতিক গ্যাস কোম্পানিগুলোর গ্যাস কেনা বাবদ মাসে পেট্রোবাংলাকে ৫ কোটি ডলার দিতে হয়। সব মিলিয়ে আগামী মে পর্যন্ত ১৯৪ কোটি ডলার লাগবে পেট্রোবাংলার। এই চাহিদা মেটাতে টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সিলেট বিভাগীয় অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ আসন্ন রমজানে সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার অভয় দিলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। গেল বছর রমজানে লোডশেডিংয়ের কথা এখনো ভুলেনি মানুষ। সেহরী-ইফতারের সময়ও বহুদিন বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হয়েছিল সিলেটবাসীকে।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *