রিজার্ভ দিয়ে আমদানি ব্যয় চলবে পাঁচ মাসেরও কম

জাতীয়

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করে এখন দেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৪.২৮ বিলিয়ন ডলারে। বর্তমান বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই রিজার্ভে পাঁচ মাসেরও কম সময় আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় থাকলেই যথেষ্ট।

বিশ্রেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর দেশের জন্য যত বেশি রিজার্ভ থাকবে তত ভালো। এছাড়া রেমিট্যান্স আর রপ্তানির ওপর জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সোমবার রিজার্ভ থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১৩৫ কোটি (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। একই সঙ্গে আমদানি দায় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। গতকাল রিজার্ভের সঙ্গে আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে দিন শেষে রিজার্ভ কমে তিন হাজার ৪২৮ কোটি (৩৪.২৮ বিলিয়ন) ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে আইএমএফের শর্ত মেনে নিলে ব্যবহারযোগ্য মজুত হবে ২৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। রবিবার জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের যে রিজার্ভ আছে সেটা দিয়ে অন্তত ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তিন মাসের আমদানি করার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট।’

আমদানি সম্পর্কিত ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। আগে সাড়ে তিন বা চার বিলিয়ন ডলারে আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মার্চ–জুন পর্যন্ত টানা চার মাসে গড়ে ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলারের (৭.৫০ বিলিয়ন) পণ্য আমদানি হয়েছে। তবে জুলাইতে এসে পণ্য আমদানি ব্যয় ৭০০ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। সরকার এখন বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে নিষেধ করেছে। আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানিতে লাগাম টেনেছে। আশা করা যাচ্ছে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও আমদানিতে লাগাম টেনে সরকার প্রতিমাসে ছয় বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ব্যয় রাখতে পারবে। সে হিসেবে আইএমএফের শর্ত মেনেও চার মাসের বেশি বা পাঁচ মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ আছে।

কর্মকর্তারা আশা করছেন, রপ্তানির ঘাটতি পূরণ হবে এবং প্রবাসীরাও রেমিট্যান্স পাঠাবেন। এতে রিজার্ভ শক্ত অবস্থানে থাকবে।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ আকুর সদস্য ছিল। তবে রিজার্ভ সংটে পড়ে গত অক্টোবর মাসে আকু থেকে বেরিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে চলতি অর্থবছরে লেনদের ভারসাম্যে ঘাটতি রয়েছে তিন দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থায় এখনই এই অবস্থার উন্নতি হওয়ার আশা নেই। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) এ তথ্যে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই, আগস্টও সেপ্টেম্বর) দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এই তিন মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে সাত দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে। এই সময়ে এক হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই হিসাব গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

গত তিন মাসে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। যা গত অর্থবছরের এই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। গত বছরে এই তিন মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ১০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চার দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখন ডলারের সঙ্গে টাকার যে মান সেটা বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। দেখা গেছে বাজারে ডলারের কয়েকটি রেট চলছে। এগুলো সমন্বয় করতে হবে। যদি ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যায় আর পণ্য আমদানি করতে গিয়ে পণ্য মূল্য বেড়ে যায় তাহলে প্রয়োজনে ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জায়গায় ভর্তুকি দিতে হবে। তাহলে কিছুটা সংকট কাটতে পারে। ইনফরমাল চ্যানেলের ডলার তখন ফরমাল চ্যানেলে চানানোর জন্য সবাই আগ্রহী হবে।’

‘আমাদের চেষ্টা করতে হবে, প্রচারণা চালাতে হবে, আইনি দিক থেকেও নজর দিতে হবে। হুন্ডি ও অর্থপাচার ঠেকাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে খোলা বাজার ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে’-যোগ করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘বাজারে ডলার নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশি মুদ্রার মান ধরে রাখতে ডলার বিক্রি করছে। তবে রিজার্ভ কিন্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাদের যতদিন সক্ষমতা থাকবে ততদিন বিক্রি করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ডলারের প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয়। এগুলো কমছে। এছাড়া অতি ধনী লোকরা বিদেশে কার্ব মার্কেটের (খোলাবাজার) মাধ্যমে ডলার নিয়ে নিচ্ছে। এদেশ থেকেও পাচার হচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে হলেও রেমিট্যান্স বৈধ উপায়ে আনতে হবে।’

রপ্তানি আরও বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অতি ধনী লোকগুলোর টাকা পাচার আটকাতে হবে। রিজার্ভে চাপ পড়ছে। আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইনকামের বেশি খরচ হয়ে গেছে। এছাড়া সামনে আমাদের ঋণ পরিশোধের সময় আসছে। আমাদের হিসেব করে এগোতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সংকটা কাটাতে আমাদের একটি দক্ষ টিম কাজ করছে। তারা সার্বক্ষণিক সব কিছুর ওপর নজর রাখছে। আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *