আর একদিন পরেই রোজা শুরু। আর রোজার আগেই বাজার থেকে উধাও বোতলজাত সয়াবিন তেল। পরিস্থিতি এমন-পাঁচ বাজার ঘুরেও মিলছে না এক লিটারের বোতল। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানও খালি। সব মিলে রমজানে বড় সংকট হতে পারে-এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন ক্রেতারা।
কিন্তু দেশে ভোজ্যতেলের কোনো সংকট নেই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার এক লাখ টনের বেশি আমদানি হয়েছে। এছাড়া পাইপলাইনে আছে আরও ৮ লাখ টনের বেশি, যা দেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছে। তারপরও বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও। আর এটির কারণ হলো সিন্ডিকেট। এখন জনগণের প্রশ্ন, এই সিন্ডিকেট ভাঙবে কবে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে ফের দাম বাড়াতে দেশের ৬-৭টি কোম্পানি ভোক্তাকে জিম্মি করে রেখেছে। সরবরাহ কমিয়ে তেলশূন্য করা হয়েছে বাজার। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণ থাকলেও অদৃশ্য শক্তির কাছে তারা বারবার মাথা নত করছে। এতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে সেই চিহ্নিত সিন্ডেকেট। ফলে বাজারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন ভোক্তা।
এদিকে রমজান সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশে উৎপাদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর আমদানি পর্যায়ে এখনো পাইপলাইনে আছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নিুমুখী।
এছাড়া বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হয়েছিল ২১ লাখ ৭০ হাজার ৩ টন। এর মধ্যে ৫ লাখ ২১ হাজার ৯৫২ টন সয়াবিন এবং ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫১ টন পাম অয়েল। চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) একই সময়ে ভোজ্যতেল খালাস হয়েছে ২২ লাখ ৭০ হাজার ২৮৯ টন। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৮৬ টন পাম অয়েল এবং ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯০৩ টন সয়াবিন তেল।
দেখা যাচ্ছে, আগের তুলনায় এক লাখ টনের বেশি তেল বেশি আমদানি হয়েছে। তারপরও বাজারে নেই ভোজ্যতেল।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টা, রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের ৭টি দোকার ঘুরে একটিতেও বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর নয়াবাজারের ৬টি মুদি দোকান ঘুরে একটিতেও বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। দুপুর আড়াইটায় কাওরান বাজারের ৫টি মুদি দোকান ঘুরে একটি দোকানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও বোতলের গায়ে মূল্য লেখা নেই। বিক্রেতারা মুছে লিটার ১৯৫ টাকা চাইছেন। যার সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৭৫ টাকা। তবে এ বাজারগুলোয় খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া গেছে। লিটার বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা। কিন্তু খোলা সয়াবিন তেলের সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৫৭ টাকা।
নয়াবাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা মো. নূরে আলম যুগান্তরকে বলেন, ঘরে তেল নেই। তাই ভেবেছি অফিস থেকে ফেরার সময় মহল্লার দোকান থেকে কিনে বাড়ি ফিরব। কিন্তু রাতে (বুধবার) লক্ষ্মীবাজারের কোনো দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল পাইনি। তাই খালি হাতে বাড়ি ফিরেছি। এজন্য সকাল থেকে (বৃহস্পতিবার) আশপাশের তিনটি বাজার-শ্যামবাজার, রায় সাহেব বাজার, তাঁতীবাজার ঘুরেও বোতলজাত তেল পাইনি। পরে নয়াবাজার এসে দেখি এখানেও নেই। রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। পাঁচটি বাজার ঘুরেও তেল পাইনি।
জিনজিরা কাঁচাবাজারে তেল কিনতে আসা মো. ইসহাক বলেন, আমি সব সময় চুনকুটিয়া বাজার থেকে কেনাকাটা করি। সেখানে বোতলজাত তেল নেই। পরে এলাকার মুদি দোকানে গিয়েও তেল পাইনি।
এরপর গোলামবাজার, হিজলতলা কাঁচাবাজার ঘুরে তেল না পাওয়ায় জিনজিরা বাজারে এসিছি। তবুও বোতলজাত তেল পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন লিটারে ২০০ টাকা দিয়ে কিনে বাড়ি ফিরছি।
একই বাজারে কথা হয় মুদি ব্যবসায়ী মো. সোহেলের সঙ্গে।
তিনি বলেন, চার মাস ধরে দেশের ছয় থেকে সাতটি কোম্পানি তাদের ডিলারের কাছে তেল সরবরাহ করছে না। তিনি জানান, রোজার আগে বাজারে সব শ্রেণির মানুষ কেনাকাটা করে। আর এ সময় কোম্পানিগুলো তেল দেওয়া বন্ধ করেছে। এতে বাজারে কোনো বোতলজাত তেল নেই। নতুন করে দাম বাড়াতেই কোম্পানিগুলো এমন করছে। সরকার দাম বাড়িয়ে দিলেই বাজারে তেলের অভাব থাকবে না। ডিলাররাও আমাদের এমন কথা বলেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিগত বছরে দেখেছি দেশে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। সরকারিভাবে দাম বাড়ালেও তারা বাজারে পর্যাপ্ত তেলের সরবরাহ করে না। আরেক দফা দাম বাড়াতে পাঁয়তারা করে। এবার রোজা ঘিরেও তারা এমন কারসাজি করে। তবুও বাজার তদারকি সংস্থা তাদের ধরছে না। শাস্তির আওতায় আনছে না।
সরবরাহ কমানোর বিষয়ে ভোজ্যতেল প্রস্তুতকারক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার যুগান্তরকে বলেন, সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছি। এটাই আমার বক্তব্য।
এদিকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি ভোজ্যতেল বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখেই বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় তাদের সংগঠনে যুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সরবরাহ করছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহের পরিমাণ বিবেচনায় সংকটের কোনো সুযোগ নেই। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা যুগান্তরকে বলেন, অন্য কোম্পানি কী করছে জানি না। সিটি গ্রুপ আগের চেয়ে বেশি তেল বাজারে সরবরাহ করছে।
বৃহস্পতিবার রমজান উপলক্ষ্যে ভোগ্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, বাজারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি অংশ এখনো সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহে কিছু ব্যবসায়ী অসহযোগিতা করছে, যা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এ সংকটের কারণ খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
শেয়ার করুন