পরিবারে সচ্ছলতা ফিরবে এমন আশায় অনিশ্চিত যাত্রা। এই যাত্রায় আছে ঝুঁকিও। এরপরও ইউরোপে যাওয়ার জন্য দলে দলে লিবিয়া যাচ্ছেন সিলেটিরা। সেখান থেকে কেউ ইউরোপে যাচ্ছেন। কেউ সাগরে নৌকা নিখোঁজ হচ্ছেন, আবার কেউ কেউ লিবিয়ায় দালালদের বিভিন্ন ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে যাদের ইউরোপে পাঠানো হয়, তারা চাকরি পান না। জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় অর্থ। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারাও যাচ্ছেন সিলেটের কেউ কেউ। তবে লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ও বন্দি সিলেটিদের সংখ্যা কত তা স্পষ্ট নয়।
তবুও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। লিবিয়াফেরত ৫৫৭ বাংলাদেশির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি করা হয়।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, এক দশকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করা লোকজনের মধ্যে যেসব দেশের নাগরিক আছেন, বাংলাদেশ ওই তালিকার শীর্ষ দশে আছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ২৫ লাখ মানুষ সাগরপথে এভাবে ইউরোপে গেছেন। এ সময় সাগরে ডুবে মারা গেছেন ২২ হাজার জন। এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও আছেন।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে যাওয়ার পথে নৌকাডুবে ৯ বাংলাদেশি প্রাণ হারান।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি। এদের বেশির ভাগেরই বাড়ি সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এলাকায়। লিবিয়াফেরত বাংলাদেশিদের তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোনো কাজ পায়নি। উল্টো নানা ঝুঁকিতে পড়েছে। শুক্রবার ভোরে লিবিয়া থেকে ১৪৪ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।
যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গেছেন। এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছে। এ বন্দিদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি ছিল। এ বাংলাদেশিদের ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছে। ৫৪ শতাংশই বলেছে, তারা কখনও তিনবেলা খাবার পায়নি; অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছে।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বলেন, দালালরা অভিভাবক ও তরুণদের ইউরোপে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখায়, যা বাস্তবে ঘটে না। কাজেই সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে। স্থানীয় দালাল ও মানব পাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযান চালাতে হবে। লিবিয়া বা অন্য দেশে থাকা মানব পাচার চক্রের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।
শেয়ার করুন