জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে প্রধান ফোকাসে রাখতে এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানকারী শক্তির আরেকটি নতুন প্ল্যাটফরম আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। আগামী এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে সামাজিক আন্দোলন নিয়ে এই সংগঠন পথচলা শুরু করবে। তবে পরে এই প্ল্যাটফরম গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দলে রূপ নিতে পারে। প্ল্যাটফরমটির নামের মূল অংশ হিসেবে ‘ছাত্র-জনতা’, ‘আজাদী’, ‘ইনসাফ’Ñ এমন শব্দ থাকবে আর শুরুতে ‘বাংলাদেশ’, ‘জাতীয়’ এবং শেষ অংশে ‘কমিটি’-জাতীয় শব্দ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তবে দু-তিন দিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সূত্র জানায়, আলী আহসান জুনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাতের নেতৃত্বে নতুন প্ল্যাটফরমের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে। আত্মপ্রকাশের দিনই ১৫১ থেকে ২০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের সবগুলো মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যন্ত কমিটি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। এসব কমিটিতে দল-মত নির্বিশেষে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ও পক্ষের যারাই আসতে চাইবেন, তাদের স্বাগত জানানো হবে।
গত রোববার ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে নতুন প্ল্যাটফরম আসার ঘোষণা দেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ শক্তির নতুন প্ল্যাটফরমের প্রধান উদ্যোক্তা পরিচয়ে পোস্টটি দেন। এই পোস্টে একটি গুগল ফর্মও যুক্ত করা হয়, যাতে গত তিন দিনে সাড়া মিলেছে প্রায় ১৫ হাজারের মতো। এ ছাড়া ফেসবুক মেসেঞ্জার, মোবাইল ফোনসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩০-৩৫ হাজারের মতো মানুষের সাড়া পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। এ সংখ্যাটা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, যা বেশ ভালো পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
আলী আহসান জুনায়েদ জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। এই উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছেন অভ্যুত্থানের আরেক সংগঠক রাফে সালমান রিফাত। তিনিও জাতীয় নাগরিক কমিটির সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব। তারা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠনের সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের দুজনের নাম আলোচনায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা দলটিতে যোগ দেননি।
নতুন প্ল্যাটফরমের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তাদের বেসিক প্রিন্সিপাল হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দাবিগুলো আবারও প্রধান ফোকাসে নিয়ে আসা এবং তা দ্রুত ও কার্যকর বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত করা। এর মধ্যে রয়েছে জুলাই শহীদ ও আহতদের মানবিক মর্যাদা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করা, ফ্যাসিবাদের জুলাই গণহত্যার বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের শাসক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি আদায়, ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর অবস্থান নেওয়া এবং দাসত্বের বদলে সমমর্যাদার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও অপরাজনীতির সামাজিক প্রতিরোধ, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ
এ বিষয়ে আলী আহসান জুনায়েদ আমার দেশকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ক্রমান্বয়ে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট আড়ালে চলে যাচ্ছে। সব দল ও সংগঠনের কাছে অন্য অনেক দাবিরে সঙ্গে এটিও একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সে কারণে কেবল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বাস্তবায়নে আমরা নতুন একটি প্রেশার গ্রুপের প্রয়োজন অনুভব করছি।
তার মতে, জুলাই শহীদ ও আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। গণহত্যার বিচার নিয়ে সোচ্চার থাকা দরকার। পুলিশের প্রমাণ সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্টি রয়েছে। এটি ঠিকভাবে করা না হলে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অনেক অপরাধী আগামীতে ছাড় পেয়ে যেতে পারে।
জুনায়েদ বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ পরপর তিনটি পাতানো নির্বাচন করে গত ১৫ বছরে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ভারতীয় স্টাবলিশমেন্ট পার্টিকুলার বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করে একটি নির্দিষ্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সহায়তা করে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কিছু ধ্বংস করেছে এবং বাংলাদেশিদের দাসে পরিণত করেছে।
সূত্রমতে, নতুন প্ল্যাটফরমের আদর্শ হবে বাংলাদেশপন্থি, ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসনবিরোধী; মধ্যপন্থি, ডান ও সেন্ট্রালাইজ পলিটিক্স। এই প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধে জড়াবে না বরং একসঙ্গে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে ঐক্য ধরে রেখে নিজেদের জায়গা থেকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নেই কাজ করবে নতুন এই প্ল্যাটফরম।
জানা গেছে, প্ল্যাটফরমটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং সামাজিক আন্দোলন হিসেবে কাজ করবে। এই কাজের মাধ্যমে মানুষের পর্যাপ্ত সাড়া পেলে এবং চাহিদার ভিত্তিতে প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলের দিকেও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্ল্যাটফরমের নামের ক্ষেত্রে এখনো কী-ওয়ার্ড হিসেবে কিছু শক্তিশালীভাবে রয়েছে। দু-তিন দিনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সূত্র বলছে, সংগঠক হিসেবে সারা দেশে ৭০ থেকে ৮০ জন কাজ করছেন। তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দল-মত নির্বিশেষে সব অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের মধ্য থেকে এই প্ল্যাটফরমে যুক্ত হতে আগ্রহীদের সঙ্গে আলাপ অব্যাহত রাখা, তথ্য সংগ্রহ ও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাফে সালমান রিফাত বলেন, ‘এটি নতুন রাজনৈতিক দল নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পলিটিক্যাল প্রেশার গ্রুপের একটি প্ল্যাটফরম হিসেবে কাজ করবে। এই প্ল্যাটফরম গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কতগুলো মূল নীতির আলোকে সব পক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
নতুন প্ল্যাটফরমের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে জুলাই বিপ্লবের সামনের সারির এই নেতা বলেন, ‘জুলাই স্পিরিট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সরে আসতে দেখছি। ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভাঙার কথা বলছি আমরা। নাগরিক কমিটিও একই কথা বলেছে। যতই সংবিধান পরিবর্তন হোক, সংশোধন হোক, সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে খুব বেশি লাভ হবে না। সে ক্ষেত্রে আমরা বলছি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা, রাজনৈতিক দলের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের বন্দোবস্তই রয়ে গেছে, এখনো চাঁদাবাজি-দুর্নীতি রয়ে গেছে। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।’
নতুন প্ল্যাটফরমের উদ্যোক্তারা বলেছেন, কার্যত জাতীয় নাগরিক কমিটি অচল, সবাই নতুন দলে চলে গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন সব রাজনৈতিক দলকে চাপ সৃষ্টি করা এবং তাদের সংলাপের মাধ্যমে একটা কমন গ্রাউন্ডে নিয়ে আসতে একটা প্রেশার গ্রুপ দরকার। এনসিপি যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে, তার আউটলাইন দেখা যাচ্ছে না। সেখানে প্রত্যাশা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসা দরকার। বিদেশনির্ভরতায় পরিবর্তন আসা দরকার। সে জন্য বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দরকার, যার মাধ্যমে সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা হবে।
শেয়ার করুন