সরকারের সহায়তায় বঙ্গবাজারেই ফিরতে চান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

জাতীয়

ঈদ, পহেলা বৈশাখসহ জাতীয় যেকোনও উৎসবকে ঘিরে আগেভাগেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বঙ্গবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ভিড় জমান খুচরা বিক্রেতারা। গত কিছুদিন ধরে তাই বিকিকিনি চলছিল পুরোদমে। এরইমধ্যে মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলো বঙ্গবাজার। ভরা মৌসুমে আগুনে সব হারিয়ে পথে বসে গেছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী।

উৎসবের এই মৌসুমে অনেকে ধারদেনা করেও ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু আগুনে এক নিমিষে সব শেষ। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর হতাশা চোখে নিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মার্কেটের সামনে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা।
বুধবার (৫ এপ্রিল) সকালে বঙ্গবাজারে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কোনও মালামাল বেঁচে গেলো কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেকে। ছাইয়ের স্তূপ ঘাঁটছেন তারা। যেখানে আগুনে সব মাল পুড়ে যায়নি, সেখান থেকে ভালো পণ্যগুলো বেছে বের করছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় রাস্তার পাশেই রাখতে হচ্ছে এসব মালামাল। এগুলো নিয়ে অনেককে বেকায়দায়ও পড়তেও দেখা গেছে। মালগুলো এখন কোথায় নেবেন, কী করবেন, বিক্রি হবে কিনা এমন নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তাদের মাথায়।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল আদর্শ মার্কেটে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কাঠের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। সেখানকার পুড়ে যাওয়া দোকানের স্মৃতিচিহ্ন বলতে শুধু কয়লা আর ছাই।। পুড়ে কয়লা হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সব।

এনেক্সকো মার্কেটের চার তলার রকি স্টলের মালিক গোলাম মুস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার ১০ লাখ টাকার মাল বেঁচে গেছে। এখনও বের করা শেষ হয়নি। বের করে রাস্তার পাশেই রাখছি। বস্তায় পানি ঢুকছে, মালামাল কতটুকু ভালো আছে বস্তা খুলে পরে বোঝা যাবে। এতোগুলো মালামাল এখন কোথায় রাখবো? বিভিন্ন জেলা থেকে যে ব্যবসায়ীরা আসতো তারা এখন আসবে না। এখন আবার এই মার্কেটে ফিরে আসতে পারবো কি না জানি না।

দুই ভাই তোয়া ফারুকী ও ইমন ২০০৪ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থেকে রাজধানীর বঙ্গবাজার এসেছিলেন সংসারের হাল ধরতে।  প্রথমে দুই ভাই বঙ্গবাজারে কাঠের মার্কেটে দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৫ সালে ‘পলক কালেকশন’ নামে ছোট একটি দোকান নিয়ে নিজেরাই ব্যবসা শুরু করেন। তারা বিক্রি করতেন মেয়েদের ওয়ান পিস কাপড়। ঈদকে সামনে রেখে স্বজনদের কাছ থেক ১৫ লাখ টাকা ধার করে একটু বেশি করে মাল তুলছিলেন এবার। আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়  সময় পার করছেন তারা।

দুই ভাইয়ের একজন ইমন বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দোকান মালিককে এক বছরের জন্য আট লাখ টাকা ভাড়া দিয়েছি। ঈদের জন্য ১৫ লাখ টাকার নতুন কাপড় তুলেছিলাম। আজ আমার সব কিছু পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। দোকানের চাবিটি শুধু আমার হাতে আছে। এছাড়া সব আমার শেষ। কোনও সহায়তা পাবো কিনা এ বিষয়ে এখনও কোনও আশ্বাস আমরা পাইনি। করোনার সময় থেকে আমরা ঋণগ্রস্ত। আমাদের জীবন শেষ। আমাদের সামনে স্বপ্নের বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চাবিটা ছাড়া আর কিছু নাই আমার কাছে।

ইমন উল্লেখ করে আরও বলেন, মা-বা স্বজনদের নিয়ে সুন্দরভাবে ঈদ পালনের ইচ্ছে ছিল। সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। আমাদের এখন একটি আবেদন, আমরা আবার এ জায়গায়ই ব্যবসা শুরু করতে চাই।

এনেক্সকো টাওয়ারের আরেকজন ব্যবসায়ী করিম খান। বেঁচে যাওয়া মাল ফিরে পেতে পাগলপ্রায় দশা তার। ওপর থেকে মাল নামাতে হাঁপিয়ে উঠচ্ছেন বার বার। তিনি বলেন, আমার দোকান পাঁচ তলায়। ৫০ লাখ টাকার মাল ছিল আমার দোকানে। সবই বাচ্চাদের পোশাক। অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যেটুকু পারি নামানোর চেষ্টা করছি। আমার আত্মীয়স্বজনের পাঁচটি দোকান পুড়েছে। কম হলেও তাদের ৫০ কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। এখন আমাদের দাবি একটাই। নতুন করে ব্যবসায় ফিরতে চাই। এ জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।

কাঠের মার্কেটের ‘মামুনা গার্মেন্টসের’ মালিক মো. সাদ্দাম হোসেন, তিন মাস আগে ভাইবোন ও স্বজনদের কাছে ধার করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আগুন লাগার দুই দিন আগেও মাকে ফোন করে বলেছি, ঈদের পর কিছু দেনা পরিশোধ করে দেবো। ওই দেনা পরিশোধ করার পথ আজ বন্ধ হয়ে গেছে।

দোকানের বাক্সে থাকা ৫০ হাজার টাকার পোড়া ব্যান্ডিল আর পোড়া কাগজপত্র নিয়ে রাস্তা রাস্তায় হাঁটছিলেন আর কাঁদছিলেন সাদ্দাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমার ব্যবসা পোড়েনি, আমার জীবনও পুড়ে গেছে। আমার মা অসুস্থ। মাকে বলছিলাম চিন্তা করো না, আমি উঠে দাড়াঁচ্ছি।

বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটের মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক  জহিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাছে লোক পাঠায়েছেন। তারা এসে আমাদের কাছে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চেয়েছেন। আমরা এ বিষয়ে আজ একটি বৈঠক করবো। এরপর আমরা তাদের তালিকা দেবো।

সরকার থেকে যে ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের কথা বলা হচ্ছে সেই সহায়তা কি শুধু মার্কেট মালিকদের দেওয়া হবে, না কি ব্যবসায়ীরাও পাবেন– এমন প্রশ্নের উত্তরে সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, মালিক-ব্যবসায়ী যারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবাইর তালিকা আমরা দেবো। বাকিটা সরকারের সিদ্ধান্ত।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *