তৃতীয় শক্তির উত্থানের মাধ্যমে প্রথমত সরকার পরিবর্তনের ছক কষছে পতিত আওয়ামী লীগ। কিভাবে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটানো যায় সেজন্য গ্রাউন্ড তৈরি করছে দলটির পালিয়ে থাকা শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে ভারতে অবস্থান করা দলটির প্রধান শেখ হাসিনা ওই দেশেরই একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার পরিবর্তনের জন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা সাজিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ দিকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এখনো ঘোষণা না হলেও ২০২৬ সালের এপ্রিলের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ধরে নিয়ে পতিত আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থিত দলগুলো বাদে দেশের অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অপর দিকে সরকার পরিবর্তনের ছক বাস্তবায়নে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে পতিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের। যদি এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য, দ্বিতীয়ত: বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে আওয়ামী লীগ আগাবে বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নজিরবিহীন পতনের পর জুডিশিয়াল ক্যু’র মাধ্যমে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য ভয়াবহ পরিকল্পনা করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রাম পুলিশের আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলন, সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সর্বশেষ এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনসহ গত ১১ মাসে গড়ে উঠা বড় বড় আন্দোলনের ওপর ভর করে সরকার পরিবর্তনের তৎপরতা চালিয়ে আসছে দলটি। ওই সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর পতিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আবারো সরকার পরিবর্তনের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় মনে করছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিএনপির ভারতপন্থী অংশটি গোপনে কাজ করলেও বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হওয়ায় ওই অংশটি অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও তাদের পুনর্বাসনের জন্য সঙ্গী হচ্ছে না-এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এজন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় তৃণমূলের ওপর ভর করে তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়েছে।
দলটির মধ্যম সারি ও তৃণমূল নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ইতঃমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে। একসময় কূটনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যদি শেখ হাসিনা দেশে ফেরত আসেন তাহলে দলের কিছুই করার থাকবে না। শেখ হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে সর্বোচ্চ বিচারের মুখোমুখি হতে হবে- যেটা দলের জন্য আরেকটি মহাবিপর্যয়। ফলে এর আগেভাগেই ভারতের সহযোগিতায় যদি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনভাবে ঘোলাটে করা যাতে অন্তর্বর্তী সরকার বাধ্য হয় তৃতীয় শক্তির হাতে ক্ষমতা দিতে। ওই শক্তিই এদেশে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আলাপকালে সহযোগী সংগঠনের এক নেতা জানান, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী কিছু আমলা, সুবিধাভোগী পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ বিশেষ বাহিনীর সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তারা সামাজিক মাধ্যম দিয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার সাথে। দিল্লী থেকে শেখ হাসিনা যেভাবে ছক বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিচ্ছেন সেভাবেই ওইসব কর্মকর্তা কাজ করছেন। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা বাছাইকৃত কিছু নেতা-কর্মীদের সাথে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। ওই নির্দেশনার আলোকেই বর্তমানে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন প্লাটফর্মে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি করতে চাইছেন। তা ছাড়া মনোবল ভেঙ্গে যাওয়া তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে ও হতাশা কাটাতে মাঝে মধ্যে শীর্ষ নেতাদের কিছু কথপোকথন বিভিন্ন মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভাইরাল করা হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তরা থানার এক ওসিকে এক আওয়ামী লীগ নেতার হুমকি সংবলিত ভিডিও তারই অংশ বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে সরকার পরিবর্তনের ইস্যু বানাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। দেশের পাড়া মহল্লায় সংঘাত সংঘর্ষ বাধিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা, দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুন, হত্যা ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত যুবলীগ-ছাত্রলীগ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে বলে জানা গেছে। এ দিকে গত ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থাকা বড় একটি অংশ বিদেশে পালিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী-এমপিদের কিছু অংশ এখনো দেশের অভ্যন্তরে রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। আর বাইরে থাকা নেতারা দেশের বিশেষ এলাকা সংশ্লিষ্ট অভিজাত ও বর্ণাঢ্য এলাকায় গোপনীয়তার সাথে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় দূতাবাসের সাথে সংযোগ রেখে তথ্য আদান প্রদানে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালে নির্বাচন দেয়ার কথা বললেও আসলে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বিএনপি একসময় নির্বাচন চাইছে আবার জামায়াত আরেক সময় চাইছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করতে পারবে না। দেশের পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটাও ঠিক, দেশে শান্তির সুবাতাস বইছে এখনো এটা বলা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যে ভালো আছে, উন্নতি হচ্ছে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। বরং দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি তত ঘোলাটে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে। দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে আওয়ামী লীগই সুবিধা পাবে। তবে ওই সুযোগে ক্ষমতায় কে যাবে, কারা দেশ পরিচালনা করবে এখনই সেটা বলা যাচ্ছে না।
নির্বাচনী পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: মিরাজ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নাই। আওয়ামী লীগকে তো নিষিদ্ধ করা হয়েছে, নিবন্ধন বাতিল করার পথে রয়েছে। এত স্বল্প সময়ে এত বড় ধাক্কা সামলিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ একেবারেই নেই। তবে দু-একজন হয়তো স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি রাজনৈতিক সমঝোতা হয়, আওয়ামী লীগ নিবন্ধন ফিরে পায়, রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের সুযোগ দেয় তাহলে অংশ নেয়া সম্ভব। আমি মনে করি, যারা অপরাধী তাদের বিচার হোক, শাস্তি হোক। আর যারা নিরপরাধ সেই সব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া উচিত।
প্রধান সম্পাদকঃ সারওয়ার খান
সম্পাদকঃ জাকের খান (রুবেল)
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫