বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার নাচনাপারা ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামের মৃত যোগেন্দ্র কর্মকারের ছেলে লাল চাঁদ। অভিজ্ঞ ওঝা হিসেবে তিনি এলাকায় বেশ পরিচিত। ৬৫ বছরের লাল চাঁদ প্রায় ৩৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে নাচনাপারার আনিসুর রহমান জুয়েলের বাড়িতে সাপ ধরতে যান।
লাল চাঁদের পরিবার বলছেন, সাপে কাটার পর লালচাঁদ যদি সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন নিতে পারতেন তাহলে তিনি হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু পাথরঘাটা কিংবা মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভ্যাকসিন ছিল না।
পাথরঘাটার সাবেক ইউপি সদস্য মো. গোলাম ছরোয়ার রুমি ওরফে বাচ্চু মেম্বার বলেন, বিষধর সাপে কামড় দিলে তখন ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ-কবচে কাজ হয় না। ভ্যাকসিন দিতে হয়। তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবচ আসলে ব্যবসার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। সাপে কাটা রোগীর জন্য লালচাঁদ ওঝা হয়ে তন্ত্রমন্ত্র আর তাবিজকবচ দিতেন। সেই সাপের কামড়েই তার মৃত্যু হয়েছে। সঠিক সময় যদি লালচাঁদ চিকিৎসা নিতে পারতেন তাহলে হয়তোবা বেঁচে যেতেন। লাল চাঁদের লাশ রাতেই গ্রামে এনে দাহ করা হয়েছে।
শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক বলেন, অত্যন্ত বিষধর সাপে লালচাঁদকে কামড় দিয়েছিল। অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন লাল চাঁদ। তার প্রস্রাব, পায়খানা ও বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া শুরু হয়েছিল। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনতে আনতে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পানি জমে ফুলে গিয়েছিল। কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে এক ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও তার মৃত্যু হয়।
রোগীকে নিতে হয় শহরে
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাপ কামড়ালে তিনভাবে বিষ মানুষের শরীরে প্রভাব ফেলে। হেমোটক্সিন বিষ রক্তকে দূষিত করে, মায়োটক্সিন বিষ মাংসপেশিকে অকার্যকর করে দেয় এবং নিউরোটক্সিন বিষ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে বিষধর সাপ কামড়ালে রোগীকে বাঁচাতে হলে শরীরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে সব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায় না। তাই রোগীদের উপজেলা বা জেলা শহরের হাসপাতাল ঘুরে বিভাগীয় শহর বা রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়। ততক্ষণে অনেক রোগী স্ট্রোক বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবার অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য না হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের বড় অংশ রোগীই ওঝা বা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিতে চলে যান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের শুরুর দিকে সারা দেশের ৮০টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়। তখন ৪১ হাজার ৪৭০ ডোজ প্রতিষেধক সরবরাহ করা হয়েছে। অধিকাংশ অ্যান্টিভেনম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, সেগুলোর মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। পরবর্তীতে অধিকাংশ জেলা ও উপজেলায় অ্যান্টিভেনম সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
উপজেলা সদরে অ্যান্টিভেনম না পাওয়া প্রসঙ্গে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, উপজেলা ও জেলা সদরে অনেক সময় অ্যান্টিভেনম থাকলেও সেখানকার চিকিৎসকেরা জটিলতার ভয়ে তা দেন না। কারণ সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন অনেকের তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এমন রোগীকে সামাল দিতে আইসিইউর দরকার হয়। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে তো সেই সুযোগ নেই, তাই সাপে কাটা রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।