সিটি নির্বাচন: ভোটে অংশগ্রহণ বাড়াতে কৌশলী আওয়ামী লীগ

জাতীয়

বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়াই আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এ লক্ষ্যে বিএনপির আগ্রহী স্থানীয় নেতাদের দলছুট প্রার্থী হতে ভেতরে–ভেতরে উৎসাহ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলকেও ভোটের মাঠে নামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি ১৪–দলীয় জোটের শরিকদের কেউ আলাদাভাবে প্রার্থী হলে তাতেও আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের। দলটির নেতাদের অনেকে বলেছেন, তাঁদের এ ধরনের কৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনার মূল বিষয়ই হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাড়ানো।

গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তারকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করা এবং তাঁকে জেতাতে আওয়ামী লীগ ও সরকারের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। উকিল সাত্তারই জয়ী হন। সেই উপনির্বাচন উকিল সাত্তার ‘মডেল’ হিসেবে আলোচিত হয়। এখন পাঁচ সিটির নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের সেই মডেল অনুসরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সিটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিএনপি সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দলটির স্থানীয় অনেক নেতা সিটি করপোরেশনের ভোট করতে আগ্রহী। এটিকে বড় সুযোগ হিসেবে নিয়ে আওয়ামী লীগ তা কাজে লাগাতে চাইছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপির কাউকে দলছুট প্রার্থী করা সম্ভব হলে একদিকে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা যাবে এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। অন্যদিকে, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির মধ্যে সন্দেহ ও অনৈক্য সৃষ্টি হতে পারে।

সিলেট, বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনায় বিএনপির নেতাদের মধ্য থেকে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন তথ্য রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কাছে। এর মধ্যে গাজীপুরে মেয়র পদে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সরকার শাহ নূর ইসলাম ওরফে রনি। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা। হাসান উদ্দিন সর্বশেষ ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলমের কাছে পরাজিত হন।

একইভাবে বরিশালে কামরুল আহসান নির্বাচনের মাঠে আছেন। তাঁর বাবা আহসান হাবিব কামাল ২০১৩ সালে বিএনপির হয়ে সিটি নির্বাচনে ভোট করে জয়ী হন। প্রয়াত আহসান হাবিব বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সিলেটে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জোর আলোচনা আছে। খুলনা ও রাজশাহীতে বিএনপির এমন কেউ প্রার্থী হোক, সেটাও চাইছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, পাঁচটি সিটি করপোরেশনের ভোট সুষ্ঠু হবে—এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে দলকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকেও খেয়াল থাকবে আওয়ামী লীগের। এ পরিস্থিতিতে মেয়র পদে প্রার্থী বেশি হলে এবং ভোটার বাড়াতে পারলে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম থাকবে।

ওই সূত্র আরও জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হোক, তা চাইছে না আওয়ামী লীগ। আর একটি ভালো জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। এ পরিস্থিতিতে দলের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে এবং ভোটের মাঠে দলের দ্বন্দ্ব কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাও বুঝতে চাইছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ ক্ষেত্রে পাঁচ সিটির নির্বাচনে দলের অবস্থান যাচাইয়ের লক্ষ্য তাদের। তবে প্রার্থী কম হলে এবং ভোটার উপস্থিতি না থাকলে সে লক্ষ্য পূরণ হবে না।

এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির ভোট নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগও দিতে চাইছে না আওয়ামী লীগ। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দলটি কৌশল ঠিক করছে বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ হবে। বৃহস্পতিবার সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে আগামী ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ খুব গুরুত্ব দিয়ে ভোট করছে এবং দলীয় প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। সব দলের বেশি বেশি প্রার্থী হোক, সেটা তাঁরা চান। তবে কে প্রার্থী হবেন, কে হবেন না—এটা নিয়ে তাঁরা ভাবছেন না।

আ.লীগ জয় চায়, তবে…

পাঁচ সিটির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা এবং এ ভোট নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দেওয়ার চেষ্টা কথা বলছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দলটি নিজেদের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে চাইছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির নেতাদের সিটি করপোরেশনের ভোটে আনার তাগিদের অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে হেরে যেতে চাইছে। আওয়ামী লীগ সব সিটিতেই জিততে চায়। একই সঙ্গে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোও তাদের লক্ষ্য।

সূত্র আরও বলছে, মেয়র পদে ভোট হবে দলীয় প্রতীকে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন। বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে ধানের শীষ প্রতীক পাবেন না। ফলে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই এগিয়ে থাকবেন। এ অবস্থায় সিলেটে আরিফুল হক প্রার্থী হলে হয়তো আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমস্যায় পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, সিলেটের বাইরে অন্য সিটিতে বিএনপির স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য হুমকি হতে পারবেন না। বরং ভোটের ভালো পরিবেশ এবং ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচনকে বেশি গ্রহণযোগ্য করবে।

কারণ গত কয়েক বছরে সংসদের বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন ছিল অনেকটাই ভোটারবিহীন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম–৮ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও ভোটারবিহীন অনেক ভোটকেন্দ্রের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির ভোটে ভোটারদের আগ্রহ বাড়ানোর তাগিদ বা চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর।

বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানোও লক্ষ্য

ক্ষমতাসীন দলটি যদিও অন্য দলের দলছুট প্রার্থী করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু তাদেরও বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দলের কেউ যাতে বিদ্রোহী প্রার্থী না হন, তা ঠেকাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্দেশনা দিয়েছে। সে জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের।

তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে তিনি নিজে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর মাকেও প্রার্থী করেছেন।

আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানোর চেষ্টা তাঁদের থাকবে। এরপরও কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাঁদের ব্যাপারে দল কঠোর অবস্থান নেবে।

১৪–দলীয় জোট সিদ্ধান্তহীন

আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে আগের সিটি নির্বাচনগুলোতে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের কেউ জোটের প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে ভোট করার সুযোগ পাননি। শরিকেরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে এবার এখনো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোটের শরিকদের সঙ্গে সিটি করপোরেশন ভোট নিয়ে যোগাযোগ করেনি। জোটেরও কোনো বৈঠক হয়নি।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জোটের শরিকেরা সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে তারা কোনো বাধা দেবে না। আর শরিকদের প্রার্থী না থাকলে তাদের সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিজে স্থানীয়ভাবে এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগ করবেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শরিকদের সমর্থন চাওয়ার সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যে গাজীপুরসহ পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন।

এদিকে ১৪ দলের শরিকদের মধ্য থেকে গণতন্ত্রী পার্টি বিভিন্ন সিটিতে মেয়র পদে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করছে। তবে কতটা ভোটারের সাড়া পাওয়া যাবে, সেই চিন্তাও করছে তারা। এর বাইরে খরচের বিষয়টি নিয়েও ভাবছে দলটি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ভাবনা কাউন্সিলর পদ নিয়ে। তারা কিছু কাউন্সিলর জিতিয়ে আনার চেষ্টা করছে। মেয়র পদ নিয়ে তারা খুব একটা ভাবছে না।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সিটির ভোট জোটগতভাবে হবে না। ব্যক্তিগতভাবে কোনো দল চাইলে ভোট করতে পারে। তবে তাঁর দল মেয়র পদে ভোট করছে না। তিনি জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যোগাযোগ করছেন।
সূত্র: প্রথম আলো

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *